google-site-verification: googlefee13efd94de5649.html মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম সন্ত্রাসবাদ - তারুণ্যের কন্ঠস্বর

HeadLine

News Update :

Sunday, November 9

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম সন্ত্রাসবাদ

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তির অবসান দাবিতে এবারই প্রথমবারের মতো পালিত হলো একটি আন্তর্জাতিক দিবস। গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এক প্রস্তাবে প্রতিবছরের ২ নভেম্বর এই দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দিবসটি উপলক্ষে এবার এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের অন্য কর্মীদের ওপর হামলা বন্ধের জন্য বিশ্বের সব দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।


আর এই দিবসটির প্রাক্কালে গত ৩০ অক্টোবর জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো জানায় যে গত দশকে সারা বিশ্বে সংবাদ সংগ্রহের জন্য নিহত হয়েছেন প্রায় ৭০০ সাংবাদিক। তাদের হিসাবে, ২০১২ সালে বিশ্বে আনুমানিক ১২৩ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নিহত হয়েছেন। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা সামান্য কিছু কমলেও ছিল ৯১, যা সাংবাদিকদের জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রাণঘাতী বছর বলে প্রতীয়মান হয়।  
কিছু মৃত্যুর জন্য বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংঘাত অর্থাৎ যুদ্ধবিগ্রহ দায়ী হলেও ৯০ শতাংশ মৃত্যুই ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ড, যার পেছনে কারণ ছিল অপরাধ ও দুর্নীতির বিষয়ে সংবাদ। জাতিসংঘের এই সংস্থাটির মূল্যায়নে এসব হত্যাকাণ্ডের ৯০ শতাংশেরই বিচার হয়নি রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব অথবা প্রয়োজনীয় সম্পদের অভাবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও নির্মম সত্য হচ্ছে, এই তালিকায় বাংলাদেশেরও ১১ জন রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির নাম পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা বন্ধ এবং হামলাকারীদের বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারগুলো কী করছে, তা জানার জন্য ইউনেসকো বাংলাদেশের কাছে তথ্য চেয়েছিল। কিন্তু যথারীতি রাজনৈতিক বিভাজনের দোষে দুষ্ট প্রশাসন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের শাসনামলে সংঘটিত সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ড সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত সম্পর্কে কোনো তথ্যই দেয়নি।
সাংবাদিকদের ওপর হামলা—তা সে প্রাণঘাতীই হোক অথবা শারীরিক লাঞ্ছনাই হোক—সেগুলোর ক্ষতটা হয় দীর্ঘস্থায়ী। ক্ষমতাধরেরা তাই এগুলোর কোনো পরিসংখ্যান পছন্দ করেন না। সরকারিভাবে এর কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। এমনকি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে খোঁজ করেও তা পাওয়া যায়নি। তবে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংকলিত তথ্য মোটেও সুখকর নয়। ২০০৮ সাল বাদে গত ১০ বছরে প্রতিবছরেই সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তাদের হিসাবে ১০ বছরে মোট নিহত হয়েছেন ২৭ জন সাংবাদিক। আর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন সাংবাদিকের সংখ্যা তিন হাজার ২৬৬ জন। এই পরিস্থিতির সামান্যতম উন্নতির আশাও ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থহীন, যতক্ষণ সাংবাদিকদের ইউনিয়নগুলো রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে বিভাজিত থাকবে। সে জন্যই প্রথম আলোর পাঠক সমাবেশে এস এম আনোয়ারের কাছে আমাদের জবাব দিতে হয়েছে, সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ থাকার কথা হলেও কেন তাঁরা বিভিন্ন দলের অনুসারী এবং বিভিন্ন অংশে বিভক্ত? আর প্রথম আলো এঁদের কোন অংশে? (গণতন্ত্রচর্চায় বলিষ্ঠ ভূমিকা চায় পাঠক; প্রথম আলো, ৮ নভেম্বর, ২০১৪)।
দলীয়, গোষ্ঠী এবং পরিবারকেন্দ্রিক স্বার্থ ও সংকীর্ণতার বৃত্তে আটকে থাকা অসুস্থ এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ধারা বজায় রাখার যে চ্যালেঞ্জ, তা মোকাবিলায় ১৬ বছর ধরে অনড় রয়েছে প্রথম আলো। ডান ও বাম—রাজনীতির এই দুই মেরুর সব পক্ষেরই অভিন্ন অভিযোগ—পত্রিকাটি সারাক্ষণ তাদের দোষ ধরে। তাদের ভালো কোনো কিছু দেখে না। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর উভয়ই যদি বলে যে প্রথম আলো তার প্রতি সদয় নয়, তাহলে এ কথা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে যে নিরপেক্ষতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতায় আমরা অবিচল?
তবে এর পরও উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা থেকে যায়। কেননা, ক্ষমতার মোহ আমাদের রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের অনেককেই এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে যে তাঁরা অসহিষ্ণু ও সংযমহীনতার নতুন নতুন মাত্রা রচনা করছেন। তাঁদের অনেকেই ইসলামি জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্যের আহ্বানের মোড়কে সব ধরনের ভিন্নমতকে দমনের পথে অগ্রসর হতে উৎসাহী। অথচ নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো একসময়ে তাঁদেরই একটি অংশকে উগ্র বামপন্থী নীতিকৌশলের কারণে একই ধরনের দমন-পীড়নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ভিন্নমত প্রকাশের জন্য নিষিদ্ধের তালিকা করা, সমালোচনার জন্য পত্রিকা বর্জনের আহ্বান, নামে-বেনামে সাংবাদিক-সম্পাদক-সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে মামলার নামে হয়রানি, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার খড়্গ, নিরাপত্তা বাহিনীসহ নানা সূত্র থেকে অনানুষ্ঠানিক উপদেশের মোড়কে হুমকি—এগুলো সবই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ। আমাদের বামপন্থী বন্ধুদের অনেকের কাছেই ইসলামি মৌলবাদ মোকাবিলায় মিসর একটি প্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্ত, যেখানে মুসলিম ব্রাদারহুডকে উৎখাতের সেনাশাসনকে তাঁরা সঠিক বলেই রায় দিয়েছিলেন।
তবে আশার কথা, সেই মিসরেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় একদল সাংবাদিক এখন এক দুঃসাহসী পথ বেছে নিয়েছেন। তাঁরা সে দেশের সম্পাদকদের সম্পাদকীয় স্বাধীনতা বিসর্জনের ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। দেশটিতে কথিত গণতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পটভূমিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় সেনাবাহিনীর শিখণ্ডী জেনারেল সিসির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানকার গণমাধ্যমের সম্পাদকেরা একটি ঘোষণাপত্র জারি করেছেন।
২৬ অক্টোবর জারি করা সেই ঘোষণায় সম্পাদকেরা সরকারের প্রতি তাঁদের সমর্থনের কথা ঘোষণা করে বলেছেন যে তাঁরা গণমাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ সমর্থনকারী উপাদানগুলোর অনুপ্রবেশ §বন্ধ করবেন। একই সঙ্গে তাঁরা তাঁদের ভাষায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও নীতিগুলোর প্রতি সংশয় সৃষ্টি করে এবং সেনাবাহিনী, পুলিশ বা বিচার বিভাগের যেসব সমালোচনা তাঁদের ভূমিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, সেগুলো প্রত্যাখ্যানের অঙ্গীকার করেছেন। মিসরীয় সম্পাদকদের এই বিবৃতিকে সাংবাদিকদের একটি বড় অংশই মেনে নিতে পারেননি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় মিসরীয় সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা খালেদ আল-বালশি বিবৃতি দিয়ে বলেছেন যে সম্পাদকদের এই বিবৃতি হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছায় সমর্পণের §দৃষ্টান্ত। তাঁর ওই বিবৃতিতে ১ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ জন স্বাক্ষর করেছিলেন।
মিসরীয় সম্পাদকদের এই ঘোষণাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্ময়কর এ কারণে যে চলতি বছরেই দেশটির একটি আদালত এক অবিশ্বাস্য ও ন্যক্কারজনক মামলায় সন্ত্রাসবাদকে সহায়তার কথিত অভিযোগে বিশ্বখ্যাত অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক আল-জাজিরার পিটার গ্রেস্টাসহ তিনজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন। পিটার এর আগে বিবিসিতে বহুদিন কাজ করেছেন এবং আমরা বিভিন্ন ভাষা বিভাগে তাঁর পাঠানো প্রতিবেদনগুলো ব্যবহারের সময় সেগুলোতে কখনো কোনো ধরনের রাজনৈতিক পক্ষপাতের লেশমাত্র দেখিনি। সেই পিটারকে মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকের লেবেল লাগিয়ে বিচার করার চেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস আর কী হতে পারে?
সাংবাদিকদের ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা একটি দায়িত্ব ও মর্যাদার বিষয় হলেও তার সঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা স্বেচ্ছায় সমর্পণের কোনো সম্পর্ক নেই। বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে সম্পাদকদের ২৬ অক্টোবরের বিবৃতিটি সংবাদপত্রগুলোকে একসুরে কথা বলানোর চেষ্টা, যাকে তাঁরা ক্ষমতাসীন শাসকের পক্ষে সম্পাদকদের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সমতুল্য বলে অভিহিত করেছেন। এটি বহুমতের ইতি ঘটাবে এবং তা সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের শাসনামলের পুনরুজ্জীবনের শামিল। এসব স্বাধীনচেতা সাংবাদিক সম্পাদকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘(মতপ্রকাশের) স্বাধীনতা স্থগিত করে সন্ত্রাসবাদকে কখনোই পরাস্ত করা যাবে না।’
মুক্ত-স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর আঘাত যে শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার দেশগুলোতেই সীমিত, তা নয়। মুক্ত বিশ্বের দেশগুলোয় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার পরও সেখানে সাংবাদিকতার ওপর নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপের নিরন্তর চেষ্টা চলছে। তবে সেগুলো অনেক সূক্ষ্ম ও কৌশলী উদ্যোগ, যা খালি চোখে দেখা যায় না। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও অন্যতম অজুহাত ইসলামি জঙ্গিবাদের হুমকি। নিরাপত্তাঝুঁকির আবরণে নাগরিকদের ওপর তীক্ষ্ণ নজরদারির জালের বিস্তৃতি এতটাই ব্যাপক যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিশ্বাসী অ্যাসাঞ্জ-স্নোডেনরাও তাঁদের বিবেককে তা মানাতে পারেননি। দেশান্তরি হয়েও স্পর্শকাতর সামরিক তথ্যও প্রকাশ করে দিয়েছেন। তাঁরা কতিপয় বহুজাতিক কোম্পানির অনৈতিক ব্যবসায়িক কৌশলের বিবরণও ফাঁস করে দিয়েছেন। তাঁদের পাশাপাশি কাজ করছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একটি আন্তর্জাতিক জোট। ফলে পশ্চিমা বিশ্বের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির পক্ষ থেকেও সাংবাদিকদের ওপর নানা ধরনের বাধা-বিপত্তি তৈরি করা হচ্ছে। এই পটভূমিতে বৈশ্বিক পরিসরে জাতিসংঘের উদ্যোগটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় কতটা সহায়ক হবে, তা বলা মুশকিল। কেননা, সদস্যরাষ্ট্রগুলো সহযোগিতা না করলে জাতিসংঘের সামনে তেমন কোনো বিকল্প নেই, যা প্রয়োগ করে তারা কাজটি আদায় করতে পারে। তবে যেসব দেশ সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত অঙ্গীকার পালনে ব্যর্থ হয়েছে বা ইচ্ছাকৃতভাবে তা করছে না, তাদের নামগুলো অন্তত প্রকাশ পাবে বলে আশা করা যায়। সে ক্ষেত্রে তাদের সম্পর্কে যে সন্দেহ জন্ম হবে, তা কি সেসব দেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন করবে না?
এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও এই বিশ্বাসটি ধরে রাখতে চাই যে বাংলাদেশেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম সচল থাকবে। সাংবাদিকদের দলকেন্দ্রিক বিভাজন, দলীয় মনোনয়নে নির্বাচনের আশা কিংবা কোনো কোনো সম্পাদকের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চাকরিপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশগুলোর ঊর্ধ্বে অনেকেই আছেন, যাঁরা বিপদের মুখেও অবিচল থাকবেন। মিসরের ওই সব স্বাধীনচেতা সাংবাদিকের চেয়ে আমরাই বা কম কিসে।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।



No comments:

Post a Comment

Thank you very much.