কটা দিন আগেও বিশ্ব জুড়ে তোলপাড় ছিল রেক্সকে নিয়ে। আর হবে নাই বা কেন, সে যে এই জগতের প্রথম কৃত্রিম মানব। না, রেক্স কোনও সাদামাটা রোবট নয়। বরং রেক্স হচ্ছে হুবহু মানুষের আদলে তৈরি একজন বায়োনিক ম্যান! এবং রেক্স নামটি এসেছে robotic exoskeleton এর সংক্ষেপ হিসাবে।
তার উচ্চতা ছয় ফিট। শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে রক্ত, শরীরে আছে বৃক্ক, প্লীহা, কিডনি, অগ্ন্যাশয় ও শ্বাসনালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এমনকি একটি কার্যকরী কৃত্রিম রক্তসঞ্চালন প্রণালীও আছে রেক্সের। আছে ন্যানোপার্টিকল দিয়ে তৈরি এর কৃত্রিম রক্ত, যা আসল রক্তের মতোই অক্সিজেনকে সংকুচিত করতে সক্ষম। এবং তার মুখখানাও কিন্তু অবিকল মানুষের মতই দেখতে।
এবং এই মুখ তৈরি করা হয়েছে গবেষকদের একজন, জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী বারটোল্ট মেয়ারের মুখের আদলে। কেননা মেয়ার নিজেও খানিটা যান্ত্রিক মানব অবশ্যই। মেয়ারের নিজের একখানা হাত নেই, তিনি জন্মেছিলেন বাম হাতটি ছাড়া। ফলে তিনি ব্যবহার করেন যান্ত্রিক একটি হাত এবং সেখান থেকেই এই বিষয়ে সকলে আগ্রহের সূত্রপাত।
ফেব্রুয়ারি ৭ হতে মার্চ মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত প্রায় এক মাস ব্যাপী রেক্সকে রাখা হয়েছিল জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত, লন্ডনের বিজ্ঞান জাদুঘরে হাউ মাচ অফ ইউ ক্যান বি রিবিল্ট? শীর্ষক একটি প্রদর্শনীতে ।
মনে পড়ে যাচ্ছে জীবনে পড়া সকল সায়েন্স ফিকশন গল্প গুলোর কথা? কিংবা মনে করুন রবিন উইলিয়ামস অভিনীত বায়োসেনটিনিয়াল ম্যান সিনেমাটির কথা। একজন রোবটের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রবিন উইলিয়ামস, যে রোবট কিনা ক্রমশ নিজের শরীরটিকে রূপান্তরিত করতে চায় মানুষের অনুরূপে। কৃত্রিম সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গই নিজের মাঝে প্রতিস্থাপিত করায় যে, এবং একসময় অনুভব তৈরি মাধ্যমে হয়ে হতে একজন সম্পূর্ণ মানুষ!!
রেক্সের ব্যাপারটিও অনেকটা তেমনই, কিংবা বলা যায় রেক্স এখন আছে সেই বায়োসেনটিনিয়াল ম্যানের একদম প্রাথমিক পর্যায়ে। ব্রিটিশ চ্যানেল ফোর এর জন্য একদল রোবট গবেষক ‘হাউ টু বিল্ড এ বায়োনিক ম্যান’ শীর্ষক টেলিভিশন প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করার সময় রেক্সকে তৈরি করেছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল- বিজ্ঞানের সীমারেখা যাচাই করে দেখা। তারা দেখাতে চেয়েছিলেন যে কিভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের এখন সাহায্যে মানুষের আসল অঙ্গপ্রতঙ্গকে কৃত্রিম যান্ত্রিক অঙ্গপ্রতঙ্গ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। এবং এই গবেষণার ফলাফল হিশাবেই জন্ম হয়েছে রেক্সের।
কেবল মানুষের অনুরূপ দেহ নয়, বায়োনিক ম্যান রেক্সের কিছুটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও রয়েছে। বিজ্ঞানের জগতে তোলপাড় তৈরি করা এই যন্ত্রমানবের বিভিন্ন অংশ তৈরি হয়েছে ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং ব্যবসায়িক উৎপাদন কেন্দ্রে, আর অ্যাসেম্বল (যন্ত্রাংশসমূহ একসাথে জোড়া লাগানো) করা হয়েছে লন্ডনের শ্যাডো রোবট কোম্পানিতে। এবং এটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে প্রায় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তবে অতি কল্পনায় যাবেন না। সায়েন্স ফিকশন গুলোর থেকে এখনও যোজন যোজন ব্যবধান আছে রেক্সের। এখনও সম্ভব অনেক অনেক অনেক উন্নতি। তবে সম্ভাবনা যাই থাকুক না কেন, এখনই কৃত্রিম মানব নিয়ে তৈরি হয়ে গিয়েছে অসংখ্য বিতর্ক। দুর্ঘটনায় বা অসুস্থতায় অঙ্গ হারানো মানুষের উন্নত চিকিৎসা সম্ভব এই কৃত্রিম অঙ্গ দিয়ে- সেই বিষয়টি মুখ্য হওয়া সত্ত্বেও সমালোচনা থেমে নেই। অনেকেই মনে করছেন যে বায়োনিক ম্যানের অর্থ খোদার ওপরে খোদকরি করবার চেষ্টা করা। আবার অনেক বিজ্ঞানীও এটা মনে করছেন যে বায়োনিক ম্যান নামক কৃত্রিম মানুষ তৈরি করলে ভবিষ্যতে কোনও একদিন সেই প্রজাতিই হুমকি হয়ে দাঁড়াবে সত্যিকারের মানব সম্প্রদায়ের জন্য।
বোস্টন ইউনিভারসিটির প্রফেসর জর্জ আয়ানাস এই সম্পর্কে বলেন যে, মানব শরীরের মানবিক ব্যাপার গুলোর পরিবর্তন বিপদ ডেকে আনতে পারে। অনেকেই চাইতে পারে নিজের আসল অঙ্গকে প্রতিষ্ঠাপিত করে শক্তিশালী কৃত্রিম অঙ্গ, যা কিনা মোটেও শুভ কোনও পরিবর্তন হবে না বলেই মনে করেন তিনি।
ভবিষ্যতে কি হবে সেই ভাবনা এখন বাদ থাকুক। আসুন, আপাতত ছবিটি দেখি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে বায়োনিক মানব রেক্স এবং একটি যান্ত্রিক হাতের মালিক মনোবিজ্ঞানী মেয়ারকে। মেয়ারের গ্লাস ধরা হাতটি লক্ষ্য করুন... হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। এই যান্ত্রিক হাতটি তার।