৭৫০ সাল থেকে ১১৬০ সাল পর্যন্ত ‘ঢাবাকা’ নামের ৪১০ বছরের সমৃদ্ধশালী বৌদ্ধ জনপদই আজকের ঢাকা মহানগরী। ১১৬০ থেকে ১২২৯ সাল পর্যন্ত মাত্র ৬৯ বছর ‘ঢাবাকা’ তথা ঢাকা জনপদ ছিল দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক থেকে আসা হিন্দু সেনবংশ দ্বারা শাসিত। দিল্লির সুলতান ইলতুতমিশের আমলে তাঁর পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি মালিক সাইফুদ্দিন আইবেক সেনবংশের এ অঞ্চলের প্রধান সূর্যসেনকে যুদ্ধে পরাজিত করে গোড়াপত্তন করেন মুসলিম শাসনের। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আনিস আহমেদের ‘ঢাকাইয়া আসলি’ গ্রন্থে এমন তথ্যই পাওয়া যায়। প্রাগুক্ত বইটির সূত্রে আরো জানা যায়, ‘ঢাবাকা’ শব্দটি সেকালের সরকারি ভাষা ফারসিতে উচ্চারিত হতো ‘ঢাওয়াকা’ বলে। একসময় শব্দের উচ্চারণগত বিবর্তনের ফলে এই শব্দটির স্বরবর্ণ ‘ওয়াও’ উহ্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে যা উচ্চারিত হয় ‘ঢাকা’ নামে। মোঘল সম্রাট আকবরের আমলে ঢাকা ছিল বাজু অর্থাৎ থানা মর্যাদার একটি শহর। ১৬০৮ সালে মতান্তরে ১৬১০ সালের জুলাই মাসের কোনো এক সময়ে দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের মনোনীত বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁ চিতশী তাঁর নৌবহর নোঙর করেন ঢাকার বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী সবচেয়ে উঁচু ভূমি চাঁদনীঘাটে। এসময় সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে পত্তন করেন ‘ঢাকা’র। সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ এ অঞ্চলকে ইসলাম খাঁ ‘জাহাঙ্গীরনগর’ নামকরণ করলেও পূর্বকালের ধারাবাহিকতায় এ জনপথের মানুষ ‘ঢাকা’ নামটিকেই ধারণ করেন স্থায়ীভাবে। তৎকালীন ঢাকায় ছিল অগুনিত মানুষের সমাগম। কারণ আঠারো শতকের মধ্যভাগে সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা ছিল বাণিজ্যের এক অন্যতম কেন্দ্র স্থল। সেসময় শস্য হিসেবে চাল ছিল পূর্ববঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্য। চাল রফতানিকারকদের সকলেই ছিলেন মাড়োয়ারি ও ভারতের মধ্য অঞ্চলের ব্যবসায়ী। তারা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ধান সংগ্রহ করতেন। সংগ্রহকৃত বিপুল পরিমাণ ধান ঢেঁকিতে ভানার কাজে তারা নিয়োগ করতেন অসংখ্য স্থানীয় শ্রমিকদের। এসব ধান ভানার কাজে শ্রমিক আসতো মূলত ঢাকার আশপাশের অঞ্চল থেকে। দীর্ঘ দিনের এ কাজের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের অবস্থান করতে হতো সেখানেই। এদিকে নিজেদের ভাব বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে তারা কথা বলতো ভিন্ন এক ভাষায়। ধান ভানার কাজে নিয়োজিত এই শ্রমিকদের মাড়োয়ারিরা সংক্ষেপে ‘কুট্টি’ নামে ডাকতো। সেই থেকে তাদের ভাষার নামকরণও করা হয় কুট্টি ভাষা। এ ভাষাটিকে অনেকে ঢাকার আদি ভাষা হিসেবে মনে করেন। তথ্যটি সঠিক নয়। এ ভাষাটি এসেছে ঢাকায় আগত একদল মানুষের মধ্য থেকে— তা তো ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে ইতিহাস পর্যালোচনা করে কুট্টি সম্প্রদায়, কুট্টি ভাষা সম্পর্কে পাওয়া যায় নানা তথ্য। মোঘল আমলেই মূলত এ ভাষার উৎপত্তি। সেখান থেকেই ওই শব্দ ও সম্প্রদায়ের উদ্ভব। এ সম্পর্কে অধ্যাপক ড. রঙ্গলাল সেন তাঁর রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছর ও উত্তরকাল গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ‘মুঘল আমল থেকে রাজধানী ঢাকার সমাজ ও সমাজ কাঠামো’ প্রবন্ধে হাফিজা খাতুন রচিত Dhakaiyas on the Move গ্রন্থের সূত্র উল্লেখ করে বলেছেন, “হিন্দুস্থানী ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় ধানভানার কাজে নিয়োজিত লোকদের মধ্যে পারস্পরিক কথোপকথনের মাধ্যম হিসেবে যে এক বিশেষ উপভাষার বিকাশ ঘটে, সেটাই কুট্টিদের ভাষা বলে গণ্য হয়।” এ কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে গবেষক অনুপম হায়াৎ উল্লেখ করেছেন, “ঢাকার এক প্রাচীন অধিবাসীদের ‘কুট্টি’ নামে অভিহিত করা হয়। কুট্টি শব্দটি এসেছে ধান কুটা বা ধান ভাঙা থেকে। ঢেঁকির মাধ্যমে ধান হতে চাল ও তুষ আলাদা করার পদ্ধতির নাম ‘ধানকুটা’। ধানকুটে জীবন-যাপন করত বলে এদেরকে ‘কুট্টি’ বলা হয়। এরা একটি পেশাজীবী সম্প্রদায়।” [‘ঢাকা কোষ’, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত]
ইতিহাসের অন্য এক সূত্র থেকে জানা যায়, ১৭৬৯ থেকে ১৭৭০ সালের দিকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। তৎকালীন নাসিরাবাদ (বর্তমান ময়মনসিংহ), কুমিল্লার সুধারাম (বর্তমান নোয়াখালি), জালালপুর (বর্তমান ফরিদপুর), বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ) সহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হতদরিদ্র অনাহারি মানুষেরা জীবিকার তাগিদে আশ্রয় নেয় ঢাকার ধোলাইখালে। তাদের প্রায় সকলেই ছিল শ্রমজীবী মানুষ। ওই মানুষদের প্রধান কাজ ছিল ধান কুটে চাল বের করা। এছাড়াও তৎকালীন ঢাকায় অবস্থান করতে আসা জমিদারদের দালান-বাড়ি তৈরিতে ইট ভাঙা বা কোটার কাজ করতো তারা। সেই সময়ের জমিদারেরা খাজনার পরিবর্তে প্রজাদের কাছ থেকে আদায় করতেন ধান। সেই ধান কুটতো এবং এ কাজ থেকে পাওয়া মজুরি দিয়ে জীবন চালাতো শ্রমিকেরা। তাদের সেই কোটার কাজ থেকেই ‘কুট্টি’ সম্প্রদায়ের জন্ম। একই সাথে ঢাকার ওই প্রাচীন জনপদকে ঘিরে উদ্ভাবন হয় নতুন এক ভাষার। ভিন্নমাত্রার এ ভাষাটির নাম ‘কুট্টি ভাষা’। একসময় কুট্টিদের বাসস্থান প্রধানত ঢাকার ধোলাইখাল এলাকা হলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও দ্রুত নগর সম্প্রসারণের ফলে শহরের আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় আবাস গড়ে তোলে তারা। কুট্টিরা বংশানুক্রমে ঢাকাবাসী এবং নিজেদের পারিবারিক ও সামাজিক ঐহিত্যের অনুসারী। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগ পর্যন্ত পরবর্তীকালে তাদের বসবাস গড়ে ওঠে ধোলাইখালসহ ফুলবাড়িয়া, নাজিরাবাজার, বংশাল, নয়াবাজার, মাহুতটুলি, দেওয়ানবাজার, চকবাজার, বেগমবাজার, সাতরওজা, মৌলভীবাজার, চকমোগলটুলি, ইসলামপুর, কলতাবাজার, কসাইটুলি, উর্দু রোড, খাজে দেওয়ান, ছোট কাটরা, বড় কাটরা, লালবাগ, নবাবগঞ্জ, হাজারিবাগ, জগন্নাথ সাহা রোড, মদনমোহন বসাক রোড, পুষ্পরাজ সাহা লেন, তাঁতিবাজার, শাঁখারিবাজার, পাটুয়াটুলি, ফরাশগঞ্জ, গেন্ডারিয়া, লক্ষ্মীবাজার, নারিন্দা, মৈশুন্দি, নবাবপুর, ওয়ারী, বনগ্রাম, হাটখোলা, টিকাটুলি, কায়েতটুলিসহ আরো অনেক এলাকায়।
ইতিহাসের অন্য এক সূত্র থেকে জানা যায়, ১৭৬৯ থেকে ১৭৭০ সালের দিকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। তৎকালীন নাসিরাবাদ (বর্তমান ময়মনসিংহ), কুমিল্লার সুধারাম (বর্তমান নোয়াখালি), জালালপুর (বর্তমান ফরিদপুর), বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ) সহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হতদরিদ্র অনাহারি মানুষেরা জীবিকার তাগিদে আশ্রয় নেয় ঢাকার ধোলাইখালে। তাদের প্রায় সকলেই ছিল শ্রমজীবী মানুষ। ওই মানুষদের প্রধান কাজ ছিল ধান কুটে চাল বের করা। এছাড়াও তৎকালীন ঢাকায় অবস্থান করতে আসা জমিদারদের দালান-বাড়ি তৈরিতে ইট ভাঙা বা কোটার কাজ করতো তারা। সেই সময়ের জমিদারেরা খাজনার পরিবর্তে প্রজাদের কাছ থেকে আদায় করতেন ধান। সেই ধান কুটতো এবং এ কাজ থেকে পাওয়া মজুরি দিয়ে জীবন চালাতো শ্রমিকেরা। তাদের সেই কোটার কাজ থেকেই ‘কুট্টি’ সম্প্রদায়ের জন্ম। একই সাথে ঢাকার ওই প্রাচীন জনপদকে ঘিরে উদ্ভাবন হয় নতুন এক ভাষার। ভিন্নমাত্রার এ ভাষাটির নাম ‘কুট্টি ভাষা’। একসময় কুট্টিদের বাসস্থান প্রধানত ঢাকার ধোলাইখাল এলাকা হলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও দ্রুত নগর সম্প্রসারণের ফলে শহরের আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় আবাস গড়ে তোলে তারা। কুট্টিরা বংশানুক্রমে ঢাকাবাসী এবং নিজেদের পারিবারিক ও সামাজিক ঐহিত্যের অনুসারী। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগ পর্যন্ত পরবর্তীকালে তাদের বসবাস গড়ে ওঠে ধোলাইখালসহ ফুলবাড়িয়া, নাজিরাবাজার, বংশাল, নয়াবাজার, মাহুতটুলি, দেওয়ানবাজার, চকবাজার, বেগমবাজার, সাতরওজা, মৌলভীবাজার, চকমোগলটুলি, ইসলামপুর, কলতাবাজার, কসাইটুলি, উর্দু রোড, খাজে দেওয়ান, ছোট কাটরা, বড় কাটরা, লালবাগ, নবাবগঞ্জ, হাজারিবাগ, জগন্নাথ সাহা রোড, মদনমোহন বসাক রোড, পুষ্পরাজ সাহা লেন, তাঁতিবাজার, শাঁখারিবাজার, পাটুয়াটুলি, ফরাশগঞ্জ, গেন্ডারিয়া, লক্ষ্মীবাজার, নারিন্দা, মৈশুন্দি, নবাবপুর, ওয়ারী, বনগ্রাম, হাটখোলা, টিকাটুলি, কায়েতটুলিসহ আরো অনেক এলাকায়।
কুট্টি ভাষাটি আরেক নাম ঢাকাইয়া ভাষা। এটি মূলত বাংলা ও উর্দু মিশ্রিত এক যৌগিক ভাষা। এছাড়া বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত এ ভাষাটি উপভাষাও নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ ভাষা হিসেবেই গণ্য হওয়া উচিত। এ ভাষা উচ্চারণে বিশেষ টান ও বলার ঢং রয়েছে। বর্তমান সময়ে ‘কুট্টি’ শব্দটি গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অতুলনীয় এ ভাষাটির ওপর এক অনন্য সাধারণ অভিধান প্রণয়ন করেছেন কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক মোশাররফ হোসেন ভূঞা। ‘ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার অভিধান‘ নামের অক্লান্ত শ্রমের ফসল এই অভিধানটি প্রণয়নে অভিধানপ্রণেতা তাঁর এ গ্রন্থের ভূমিকাতে উল্লেখ করেছেন, “একটি জাতি বা সম্প্রদায় তো একদিনে জাদুমন্ত্রে গড়ে ওঠে না। দীর্ঘ যাত্রায়, সীমাহীন শ্রমে, অতুলনীয় ত্যাগে, অবর্ণনীয় তিতিক্ষায় ও গ্রহণ-বর্জনের কঠিন প্রস্তরে গড়ে ওঠে। আজ, এই কালে সেই ধূসর সময়ের শেষ প্রান্তে বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়ে তাকালে কিছুটা অস্পষ্টতা, মানুষের দায় হচ্ছে, ঐ কুয়াশার চাদর ভেদ করে ইতিহাসের সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও চলমান সময়ের কাছে উপস্থাপন করা। ‘কুট্টি’দের বা আদি ঢাকার আদি আদিবাসীদের মুখের ভাষা ও শব্দ নিয়ে এই অভিধানও সেই অমোঘ দায় পূরণের সামান্য চেষ্টা মাত্র।” অভিধানটিতে মোট ৩৯৯১টি শব্দ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আভিধানিকের মতে, নিবিড় জরিপ, সরাসরি অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণ অর্থাৎ নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে গবেষণার মাধ্যমে শব্দ সংগ্রহ করলে এই সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারতো। শব্দ সংকলন সম্পর্কে তিনি বলেন, “শব্দ সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমার প্রচেষ্টা ছিল আংশিক নৃতাত্ত্বিক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঢাকাইয়া বাংলা অর্থাৎ কুট্টি ভাষায় বা কুট্টিদের নিয়ে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থাদি থেকেই মূলত শব্দগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ অর্থাৎ জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমেও শব্দ সংগ্রহ করা হয়েছে।”
সহজিয়া ভঙ্গিতে ও সরল আঙ্গিকে মনের ভাব প্রকাশ করে কুট্টি ভাষা। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসেছে এ শ্রুতিমধুর ভাষাটি। ভাষাটিকে বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হয়েছেন মোশাররফ হোসেন ভূঞা। কঠোর পরিশ্রমলব্ধ এ দুরূহ কাজটির জন্য অবশ্যই তিনি অকৃত্রিম প্রশংসার দাবিদার। পুরোনো ঢাকার প্রাণবন্ত মানুষের মতো তাদের ভাষাও জীবন্ত, জাগ্রত— এই অভিধান পাঠে সেই সত্যতাই মিলবে বলে আশাবাদী আভিধানিক। তাঁর এ দাবির সঙ্গে একমত না হওয়ার কোনো যুক্তিই নেই।
=====================================================================
ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার অভিধান; সংকলন ও সম্পাদনা : মোশাররফ হোসেন ভূঞা; প্রকাশক : ঐতিহ্য ; প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ; পৃষ্ঠা : ৩৪৪
No comments:
Post a Comment
Thank you very much.