সূত্র জানায়, এহেন কার্য সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্ট মূল্যায়ন কমিটি পরিবর্তন করা হয়েছে। মূল্যায়ন কমিটির যেসব কর্মকর্তা মন্ত্রীর অবৈধ ইচ্ছা পূরণে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তাদের ওএসডি করা হয়েছে। নতুন কমিটির ওপরও প্রচণ্ডভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয় বেশি মূল্য নির্ধারণ করে রিপোর্ট পেশ করার জন্য। একে কেন্দ্র করে কমিটির একাধিক সদস্য এ সংক্রান্ত সভাতেও অংশ নেননি।
পছন্দের কমিটি যে অস্বাভাবিক দাম নির্ধারণ করে সুপারিশ পেশ করেছে তারচেয়েও বেশি দামে জাহাজ কিনতে কমিশন ভিত্তিক একটি বিদেশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রাথমিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছে। চীনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিএমসির সঙ্গে গত ৩০ এপ্রিল ওই চুক্তি করা হয়।
সূত্র জানায়, প্রথম যে মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল সেই কমিটি বিদেশে গিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে এসে ওই ছয় জাহাজের দাম ১৫৬ মিলিয়ন ডলার বা ১,২১৬ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৭৮ টাকা ধরে)। মন্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী চুক্তি হয়েছে ১৮৪.৫ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১,৪৩৯ কোটি টাকা)। যা মূল্যায়ন কমিটির প্রস্তাবনার চেয়ে ২৮.৫ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২২৩ কোটি টাকা) বেশি। উল্লেখ্য, পরবর্তীতে নতুন কমিটি মন্ত্রীর পছন্দের যে রিপোর্ট পেশ করেছিল তাতে মূল্য ধরা হয়েছিল ১৭৫ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, এই কমিটির সুপারিশের চেয়েও প্রায় ৭৪ কোটি টাকা বেশি দাম ধরে চুক্তি করা হয়েছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুযায়ী, জাহাজ ক্রয়ের এই চুক্তিতে সবচে’ বড় জালিয়াতিটি হয়েছে, যে প্রতিষ্ঠানের জাহাজ কেনার জন্য আলাপ-আলোচনা চলছিল এবং কমিটির সদস্যরা জাহাজ উৎপাদনকারী যে প্রতিষ্ঠানের শিপইয়ার্ড পরিদর্শন করে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার দাম নির্ধারণ করেছিল সেখান থেকে এখন জাহাজ কেনা হচ্ছে না। চুক্তিতে নতুন একটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে যা এ সংক্রান্ত কমিটির সদস্যরা জানেনই না। নতুন এই প্রতিষ্ঠানের নামও শোনেননি তারা কখনো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ছয়টি নতুন জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিএসসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মকসুমুল কাদেরকে প্রধান করে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। চীনা প্রতিষ্ঠান সিএমসি’র সঙ্গে আলোচনা চলে। উল্লেখ্য, সিএমসি জাহাজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি চীনা সরবরাহকারী অর্থাৎ মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠান। সিএমসি’র প্রস্তাব অনুযায়ী জাহাজ ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির সদস্যরা সংশ্লিষ্ট জাহাজ প্রস্তুতকারী শিপইয়ার্ড পরিদর্শন করেন। এছাড়া কমিটি ক্লার্কসম এবং আরো কয়েকটি এডজাস্টার কোম্পানির মতামত নেয়। পরিদর্শন এবং এডজাস্টার কোম্পানির মতামতের ভিত্তিতে ওই ক্যাটাগরির ছয়টি জাহাজ ক্রয়ের ব্যয় নির্ধারণ করে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার। কমিটি সে অনুযায়ী একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দেয়।
কিন্তু মন্ত্রী এতে ক্ষুব্ধ হন। তিনি চেয়েছিলেন, মূল্য বেশি করে নির্ধারণ করতে। এজন্য কমিটির ওপর চাপও প্রয়োগ করেছিলেন। কমিটির চেয়ারম্যান, শিপিং করপোরেশনের এমডি কমোডোর মকসুমুল কাদের মন্ত্রীর ওই অবৈধ আবদারে সায় দিতে চাইলেও অন্য সদস্যদের আপত্তির মুখে সম্ভব হয়নি। কমিটি প্রকৃত রিপোর্টই জমা দেয়। এর জের হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে তদবির করে কমিটির সদস্য, শিপিং করপোরেশনের নির্বাহি পরিচালক (কমার্শিয়াল) মোস্তফা কামাল উদ্দিন ও নির্বাহি পরিচালক (অর্থ) গোলাম মওলাকে ওএসডি’র ব্যবস্থা করেন মন্ত্রী।
সূত্র জানায়, যে ছয়টি নতুন জাহাজ কেনা হচ্ছে, এর মধ্যে তিনটি ওয়েল ট্যাংকার ও তিনটি ভেসেল। রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী জাহাজ কেনার জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কমিটি গঠন ও উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করতে হয়। বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে হলে তাতে আইন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি নিতে হয়। এক্ষেত্রে কোনোটিই করা হয়নি। বরং গত ৩০ এপ্রিল ব্যাপক অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিয়ে তড়িঘড়ি করে চীনা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে।
শিপিং করপোরেশনের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, কয়েকদিনের মধ্যেই নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেই সভায় জাহাজ ক্রয়ে এ অনিয়মের প্রসঙ্গটি উঠতে পারে এবং তা মন্ত্রীর দুর্নীতির পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আর তাই এ সভার আগেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে কমিশনভিত্তিক চীনা সরবরাহকারী কোম্পানির সঙ্গে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, গত কয়েকদিন ধরেই মন্ত্রণালয় ও শিপিং করপোরেশনে জাহাজ কেনার চুক্তির বিষয়ে সভা হচ্ছিল। সভায় এত উচ্চমূল্যে জাহাজ কেনার প্রস্তাব কোনো ক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে কর্মকর্তারা জোর আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। কর্মকর্তারা বলেন, এতে বড় ধরনের দুর্নীতির আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রের মোটা অঙ্কের টাকারও অপচয় হবে।
উল্লেখ্য, এই জাহাজ ক্রয়কে কেন্দ্র করে দু’জন কর্মকর্তা ইতিপূর্বে ওএসডি হয়েছেন। তাই কর্মকর্তারা আতঙ্কের মধ্যে আছেন। মন্ত্রী এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে চুক্তি স্বাক্ষর করিয়েছেন। শুধু উচ্চমূল্যই নয়, আদতে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কী মানের জাহাজ কেনা হচ্ছে সেটাও এখন কমিটির সদস্যরা জানতে পারছেন না।


No comments:
Post a Comment
Thank you very much.