ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ১টা বেজে ৩৮ মিনিট। গুলশানে বেগম জিয়ার কার্যালয়ের চার পাশে অপেক্ষমাণ হাজারো মানুষ। কখন আসবে আরাফাত রহমান কোকোর লাশ। নির্বাক সবাই। ক্ষণে ক্ষণে তাদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল পবিত্র কালেমায়ে শাহাদাত আর আল্লাহ আল্লাহ ধ্বনি। অনেকেই হাতে তসবিহও জপছিলেন। অপেক্ষার প্রহর শেষে বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে গুলশান কার্যালয়ে পৌঁছায় কোকোর লাশ। সেখানে নেমে আসে শোকের ছায়া। কার্যালয়ের ভেতরে ছেলের নিথর মুখ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন খালেদা জিয়া। শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন তিনি। কখনো ডুকড়ে কান্না আবার কখনো নাতনীকে জড়িয়ে কান্না। দুই নাতনীর সাথে দাদীর কান্না যেন একাকার হয়ে যায়। এ সময় অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হয় সেখানে। সন্তানের শোকে কাতর খালেদা জিয়ার চোখের পানি দেখে অন্যরাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। শেষ বিদায়ে সন্তানের দুই গালে মা হিসেবে হাত বুলিয়ে দেন খালেদা জিয়া। একপর্যায়ে কোকোর রূহের মাগফিরাত কামনায় স্বজনদের নিয়ে কার্যালয়েই দোয়া করেন তিনি। এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় গুলশান কার্যালয়ে। সেখান থেকে কোকোর লাশ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে নেয়ার সময়ও অশ্রুসিক্ত নয়নে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সেটাই ছিল সন্তানের প্রতি তার শেষ বিদায়।
এদিকে মালয়েশিয়া থেকে ঢাকায় কোকোর লাশ আনার খবর জানার পর নেতাকর্মী ছাড়াও চার দিক থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন গুলশানে। শোকার্ত মানুষের আগমনে ওই এলাকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। তৈরি হয় এক আবেগঘন পরিবেশ।
গত শনিবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো। আনুষ্ঠানিকতা শেষে গতকাল দুপুর পৌনে ১২টার দিকে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের বিমানে করে কোকোর লাশ মালয়েশিয়া থেকে ঢাকায় আনা হয়। কোকোর লাশ গ্রহণের জন্য বিমানবন্দরে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, আবদুল্লাহ আল নোমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, ফজলুল হক মিলন, গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আবদুল মান্নান প্রমুখ। বিমাবনন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কোকোর কফিন গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হয়। একই বিমানে ঢাকায় এসেছেন কোকোর স্ত্রী, দুই মেয়ে, মামা শামীম এস্কান্দার ও খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা আলহাজ মোসাদ্দেক আলী।
আলিফ মেডিক্যাল সার্ভিসের একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে বিমানবন্দর থেকে কোকোর লাশ গুলশানে পৌঁছায় বেলা ১টা ৩৫ মিনিটে। বিপুল নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ভিড় ঠেলে ১টা ৪৮ মিনিটে লাশ বের করে রাখা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের নিচতলার রুমে। সোনালি ফ্রেমে বাঁধা কাঠের কফিনের ওপরে রাখা ছিল কালেমায়ে শাহাদাতখচিত কালো কাপড়। নিজের সন্তানকে শেষবারের মতো এক নজর দেখতে দ্বিতীয়তলার নিজ অফিস ক থেকে নিচতলায় আসেন খালেদা জিয়া। কার্যালয়ে ছেলের লাশের পাশে আধাঘণ্টার বেশি অবস্থান করেন তিনি। পুরো সময়ই তার চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। পরিবারের অন্য স্বজনেরাও সে সময় উপস্থিত ছিলেন।
অশ্রুসিক্ত নয়নে শেষ বিদায় : পৌনে ২টার পর কোকোর লাশ রাখা হয় গুলশান কার্যালয়ের নিচতলায়। সন্তানের কফিনের পাশে বসে পড়েন মা বেগম জিয়া। প্রায় সময় টিস্যু দিয়ে চোখের পানি মুছছিলেন তিনি। সাদা কফিনে সাদা পোশাকে শুয়ে আছেন কোকো। মা যখনই ছেলের দিকে তাকাচ্ছিলেন, তখনই কাঁদছিলেন শিশুর মতো। এ এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। বেগম খালেদা জিয়ার পাশে ছোট দুই ভাইয়ের স্ত্রী, কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিথি, দুই মেয়ে জাফিয়া ও জাহিয়া ছিলেন। নিচতলায় পরিবারপরিজনের বাইরে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। পারিবারিকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন চলে অনেকণ। কফিনের পাশে বসে দুই হাত তুলে ছেলের জন্য অশ্রুসিক্ত চোখে মুনাজাত করেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা: জোবাইদা রহমানের মা সৈয়দা ইকবালমান্দ বানুসহ তাদের আত্মীয়স্বজন ছাড়াও সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, বিশেষ সহকারী শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মাহবুব আলম ডিউ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ সময় পাশের কে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত চলছিল।
দীর্ঘ দিন পর নিজের সন্তানের লাশ দেখার পর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেন মা খালেদা জিয়া। এরপর কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে যান। পরে তাকে স্বজনেরা ধরে থাকেন এবং সান্ত্বনা দেন। পরিবারের সদস্যরা শেষবারের মতো দেখার পর কোকোর লাশ বেলা পৌনে ৩টার দিকে গুলশান কার্যালয় থেকে বায়তুল মোকাররমের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময়ও মা খালেদা জিয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রায় পাঁচ মিনিট গুলশান কার্যালয়ের মূল ফটকে দাঁড়িয়ে ছেলেকে বিদায় জানান। চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার ও শায়রুল কবির খান এবং অন্যরা লাশ অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেন।
নির্বাক খালেদা জিয়া : আদর সোহাগ দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলা ছোট ছেলেকে সবার আগে বিদায় জানাতে হবে এটা কখনো ভাবেননি খালেদা জিয়া। ছেলের অকাল মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান তিনি। কোকোর লাশকে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানানোর পর নির্বাক খালেদা জিয়া। প্রায় ৫ মিনিট মুখে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিলেন। এ সময় বেগম খালেদা জিয়ার দুই চোখ থেকে শুধু পানি গড়িয়ে পড়ছিল। সেখান থেকে কার্যালয়ে দ্বিতীয়তলায় খালেদা জিয়াকে নিয়ে যান স্বজনেরা। তার ব্যক্তিগত রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন তিনি। গতকাল সারা দিন তিনি শুধু পানি খেয়েছেন বলে জানা গেছে।
জনকীর্ণ গুলশান ৮৬ নম্বর সড়ক : রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরের ৮৬ নম্বর সড়কে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়। তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর লাশ মালয়েশিয়া থেকে আনার খবর জানতে পেরে গতকাল সকাল থেকেই সেখানে জড়ো হতে থাকেন কোকোর পরিবারের সদস্য, বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী, শুভাকাক্সীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার হাজার হাজার মানুষ। অপেক্ষার প্রহর শেষে বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে গুলশানে পৌঁছায় কোকোর লাশ। শোকার্ত মানুষের আগমনে পাল্টে যায় সেখানকার পরিবেশ। চার দিক থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে এসে জড়ো হন। ধীরে ধীরে জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে গুলশানে খালেদা জিয়ার কার্যালয়। তৈরি হয় শোকের আবহ। লোকসমাগম এতই ছিল যে, অ্যাম্বুলেন্সটি কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকতে প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগে। এ সময় শিমুল বিশ্বাস কার্যালয়ের বাইরে অপেক্ষমাণ হাজার হাজার মানুষকে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য মাইকে আহ্বান জানান। সে সময় সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির সন্তান হিসেবে কোকোর লাশ বনানী আর্মি গোরস্থানে দাফন করতে না দেয়ার জন্য নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান তিনি।
এ দিকে কার্যালয়ের বাইরে অপেক্ষমাণ হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ আরাফাত রহমান কোকোর রূহের মাগফিরাত কামনা করে আল্লাহর দরবারে বিশেষভাবে মুনাজাত করেন।
সবশেষে ২টা ৪১ মিনিটে আরাফাত রহমান কোকোর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স ও কয়েকটি গাড়ি নিয়ে নামাজে জানাজার জন্য বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উদ্দেশে রওনা দেয়। বিএনপি ছাড়াও ২০ দলীয় জোট এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার হাজার হাজার মানুষ সেই গাড়িবহরের পেছনে পেছনে যান।
ছিল কড়া নিরাপত্তা : এ দিকে কোকোর লাশ আসা উপলে বিমানবন্দর ও আশপাশের এলাকায় ছিল কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও র্যাব। বিমানবন্দর এলাকায় জড়ো হন বিএনপির বিপুল নেতাকর্মী। তবে তাদের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
- See more at: http://www.dailynayadiganta.com/details.php?nayadiganta=MTA0ODY4&s=MQ%3D%3D#sthash.Yi4zTPgj.dpuf


No comments:
Post a Comment
Thank you very much.