google-site-verification: googlefee13efd94de5649.html মহাজোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে চলেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) - তারুণ্যের কন্ঠস্বর

HeadLine

News Update :

Thursday, June 4

মহাজোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে চলেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)

.ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের দালিলিক প্রমাণ পাওয়ায় মহাজোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে চলেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। জানা গেছে, কমিশনের সিদ্ধান্তের পর তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক মামলা দায়ের করা হবে। তঁ​াকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা ভাবছে দুদক।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম। অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি। তবে সংস্থার উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, অনুসন্ধানে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সরকারের বিপুল পরিমাণ ক্ষতির দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফলে দুদকের মামলায় ফেঁসে যেতে পারেন আওয়ামী লীগের সাবেক এ প্রভাবশালী নেতা। দুদকের সূত্রটি জানায়, অভিযোগের বিষয়ে শিগগিরই কারাবিধি মেনে লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্য নেওয়া হতে পারে।
লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যতটুকু জানি, তাঁর সম্পর্কে একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন দুদকের দৈনন্দিন সভায় উপস্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছে। কমিশনের সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে পবিত্র হজ ও তাবলিগ জামাত এবং প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় মন্ত্রিসভা ও দল থেকে অপসারিত হন লতিফ সিদ্দিকী। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকা ও দেশের ১৮টি জেলায় অন্তত ২২টি মামলা রয়েছে। দেশে ফিরে আসার গত বছরের ২৫ নভেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করলে লতিফ সিদ্দিকীকে কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন তিনি। গত মঙ্গলবার সাত মামলায় হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তী জামিন পেয়েছেন তিনি।
অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, মহাজোট সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী ২০১৩ সালে ক্ষমতা ছাড়ার চার দিন আগে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে নিশাত জুট মিলের ১১ কাঠা ১৩ ছটাক জমি ওই বছর ঢাকার চট্টগ্রাম সমিতিকে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেন৷ মতিঝিলে মধুমিতা সিনেমা হলের পেছনে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন ওই জমির বর্তমান বাজারমূল্য ১৫০ কোটি টাকারও বেশি বলে ধারণা করা হয়। এক কোটি এক লাখ টাকায় ৯৯ বছরের জন্য চট্টগ্রাম সমিতিকে জমিটি ইজারা দেওয়া হয়। ওই সমিতির সভাপতি লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী৷
২০১৩ সালের ১১ জুন চট্টগ্রাম সমিতি হাসপাতাল তৈরির কথা জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে জমির জন্য আবেদন করে। মহাজোট সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার চার দিন আগে ২০ অক্টোবর লতিফ সিদ্দিকী তাতে সম্মতি দেন। পরদিন ২১ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নীলরতন সরকার চট্টগ্রাম সমিতির তখনকার সভাপতি রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাককে চিঠি দিয়ে জমিটি ইজারা দেওয়ার কথা জানান৷ ইজারামূল্য প্রতিবছর এক লাখ এক হাজার ১০১ টাকা হিসেবে ৯৯ বছরের জন্য এক কোটি এক লাখ এক হাজার ১০১ টাকা বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ১২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার শপথ নেয়৷ তার তিন দিনের মাথায় ১৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সমিতিকে জমিটি ইজারা দলিল করে দেয় মন্ত্রণালয়৷
জমিটি ইজারা অনুমোদনের নথিতে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘মেজবান চট্টগ্রাম সমিতির একটি আকর্ষণীয় বাৎসরিক অনুষ্ঠান। ব্যক্তিগত জীবনে আমি চট্টলা কন্যার পাণি গ্রহণ করেছি। ঢাকার চট্টগ্রাম সমিতি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। তাদের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় এই ভূমি খণ্ডটির প্রয়োজনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানবতার সেবায় তাদের সহযোগিতা করার নৈতিক দায়িত্ববোধ করছি।’
অবশ্য গত বছরের ২১ অক্টোবর সেই জমির ইজারা বাতিল করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। চুক্তিটি বাতিল করে চট্টগ্রাম সমিতির সভাপতির কাছে চিঠিও পাঠানো হয়।
চট্টগ্রাম সমিতিকে জমি ইজারা দেওয়া ছাড়াও চিশতি জুট মিল, মোহিনী জুট মিল ও মুসলিম কটন মিল বিনা টেন্ডারে হস্তান্তরের বিষয়টিও অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম। এসব কারখানা হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও লতিফ সিদ্দিকী কোনো নিয়ম মানেননি বলেও অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়েছে দুদক।
একক সিদ্ধান্তে মোহিনী মিলস বিক্রি: কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলস লিমিটেড লোকসানের কারণে ১৯৮২ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৮৪ সালে দরপত্রের মাধ্যমে নজরুল ইসলামে নামের এক ব্যক্তি সেটি কিনে নিয়ে নামকরণ করেন শাহ মখদুম টেক্সটাইল মিলস। তখন মিলটির বিক্রয়মূল্য ছিল ১১ কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল প্রায় ১৩ কোটি টাকা। নজরুল ইসলাম টাকা ঠিকমতো পরিশোধ করতে না পারায় দরপত্র বাতিল করা হলে তিনি আদালতে মামলা করেন। ২০০৯ সালে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি ফয়সালার নির্দেশ দিলে মামলা প্রত্যাহারের শর্তে ওই প্রতিষ্ঠানকে কিস্তি, দায়দেনাসহ ৪৯ কোটি টাকা পরিশোধের জন্য বলা হয়। পরে শাহ মখদুম টেক্সটাইল মিলের পক্ষে দ্য পিপলস ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন নামে একটি মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান টাকা পরিশোধে রাজি হয়। কিন্তু মামলা প্রত্যাহার বা টাকা পরিশোধ না করায় মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী মিলটি ফেরত না নিয়ে একক সিদ্ধান্তে আবদুল মতিন নামের আরেক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রির নির্দেশ দেন। শেষ পর্যন্ত তিনিও কোনো টাকা পরিশোধ করেননি। এরপর এনারগোটেক নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক আরিফুর রহমানের সঙ্গে মিলটি বিক্রির জন্য চুক্তি করা হয়। তিনিও সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করেননি। এরপর অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বারবার মিলটি বেসরকারি কমিশনের কাছে ন্যস্ত করার কথা বললেও মন্ত্রী নিজেই মিলটি বিক্রির কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। বিক্রির পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিল অবৈধ। এ ছাড়া মিলটি প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে।
মসলিন কটন মিল অবৈধভাবে বিক্রয় ও হস্তান্তর: গাজীপুরের কালীগঞ্জের মসলিন কটন মিল বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনকে (বিজেএমসি) ন্যস্ত করা হয়। এরপরও ২০১১ সালে এটি রিফাদ নামে একটি পোশাক কারখানার কাছে ১৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়, যা সম্পূর্ণ বেআইনি বলে অভিযোগ রয়েছে। মিলটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হস্তান্তর করা ছাড়াও এর দায়দেনা ও মূল্য যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয়নি বলেও অনুসন্ধানে জানা গেছে। এ ছাড়াও সরকার ও ক্রেতা পক্ষ শ্রমিকদের বকেয়া পাওনার বিষয়টি এড়িয়ে যায়। অভিযোগ আছে, এসব অনিয়মকে প্রশ্রয় দিয়েছেন লতিফ সিদ্দিকী।
চিশতি টেক্সটাইল: কুমিল্লার দৌলতপুরের ঐতিহ্যবাহী চিশতি টেক্সটাইলের ১৬ দশমিক ৬৬ একর জমিসহ মিলটি বিনা টেন্ডারে মাত্র ৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়। অথচ ওই জায়গার সর্বনিম্ন বাজার মূল্য কমপক্ষে ১৫০ কোটি টাকা। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ মিলটি বিনা টেন্ডারে ২০১০-২০১১ অর্থবছরে মন্ত্রীর ইচ্ছায় মাত্র ৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়। ওই মিলটি কেনেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আমস ফারাজ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের মালিক মো. ফারুক ইসলাম ভূঁইয়া।
পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকার সময় লতিফ সিদ্দিকীর কর্মকাণ্ড বিশেষ করে ওই মন্ত্রণালয়ের সম্পত্তি বেসরকারীকরণের ক্ষেত্রে আইন ও বিধি মানা হয়েছে কি না এবং চুক্তির শর্ত মেনে সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর হয়েছে কি না, তা যাচাই করার জন্যই গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক পবন চৌধুরীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ৩১ আগস্ট বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর নানা অনিয়মের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়।
দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই প্রতিবেদনটিও তাঁর অনুসন্ধানের কাজে ব্যবহার করছেন। আরও দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন।
ওই কমিটি বলেছিল, পাঁচ বছরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ৪৮টি সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে হস্তান্তর বা বিক্রি করেছে। এ সময় দুটি ছাড়া বাকি সব প্রতিষ্ঠান বিনা দরপত্রে, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, বিনা মূল্যে বা কম মূল্যে বেসরকারীকরণ বা বিক্রি করা হয়। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড করেছেন। সব ধরনের আইনকানুন, নিয়মনীতি ভঙ্গ করে তিনি সরকারি সম্পত্তি হস্তান্তর করেছেন। আইন বা নীতিমালা মানার ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য ছিল ‘নীতিমালা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ কর’।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে (২০০৯-১৩) বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের বিটিএমসি, তাঁত বোর্ড, বিলুপ্ত জুট করপোরেশন (বিজেসি) এবং বিজেএমসির মোট ৪৮টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ ও হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ঈগল স্টার টেক্সটাইল মিলের ঋণের সুদ মওকুফ করা হয়। ৩০টি প্রতিষ্ঠান পূর্ণাঙ্গ হস্তান্তর করা হয়, ১৭টি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াধীন। এর মধ্যে বিনা দরপত্রে দেওয়া হয়েছে ১২টি। এভাবে সম্পত্তি হস্তান্তরের কারণে জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। তা ছাড়া বেসরকারীকরণ কমিশন আইন ও নীতিমালাও মানা হয়নি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪৬টি প্রতিষ্ঠান বা ভূমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে করা অনিয়মগুলো হচ্ছে যথাযথ মূল্য নির্ধারণ না করা, বিনা দরপত্রে হস্তান্তর, কেবল মন্ত্রীর সিদ্ধান্তে বিনা মূল্যে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া, বিক্রির আগে অর্থনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন না নেওয়া, বিক্রির শর্ত না মানা, আইনগত জটিলতা নিরসন না করেই হস্তান্তর ইত্যাদি।