চারপাশে অপেশাদারির জঞ্জাল। তার মাঝে সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবটা যেন গোবরে পদ্মফুল। হঠাৎ ধূমকেতুর মতো গত বছর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে প্রথম নাম লিখিয়েই রানার্সআপ। প্রিমিয়ারে উঠে এসেই জানিয়ে দিয়েছে লিগ শিরোপা জয়ের দাবি। যেন স্বপ্নের মতো শুরু।
ঘরোয়া শীর্ষ ফুটবলে খেলতে নিচ থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি ভাঙতে হয়নি সাইফ স্পোর্টিংকে। ফুটবল পৃষ্ঠপোষক তরফদার রুহুল আমিনের ইচ্ছার মূল্য দিয়েছে বাফুফে। সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একটি ফুটবল দল গড়তে চেয়েছেন। সেটিই এই সাইফ স্পোর্টিং। পেশাদারির পথে হেঁটে বাংলাদেশের সেরা তো বটেই, দেশের বাইরেও সাড়া ফেলবে যে দল।
লক্ষ্য পূরণে আবির্ভাবেই দীর্ঘ ও আগ্রাসী পরিকল্পনা নিয়েছে নবাগত দলটি। পেশাদার কাঠামো অনুসরণ করে যেন দৌড়াচ্ছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এক বছরে নাকি দলটির খরচ হবে ১০ কোটি টাকার ওপরে।
এত টাকা! বাংলাদেশের ফুটবলে একজন বিদেশি কোচ রাখতেই হিমশিম খায় বড় দলগুলো। সেখানে সাইফের প্রধান ও সহকারী কোচ দুজনই বিদেশি (ব্রিটিশ)। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় মাসে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় একটি পাঁচতলা বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে ক্যাম্পের জন্য। খেলোয়াড়দের সবার কক্ষই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। সব কক্ষে ফ্রিজ আছে, যা খেলোয়াড়দের কাছে নতুন। ক্লাবের খাবারের মানও উন্নত।
কোনো কোনো ক্লাবের মতো এক কক্ষে ট্রেনের কামরার মতো আটটি খাট ফেলে ১৬টি বিছানা নয়, সাইফের ক্যাম্পে প্রতি কক্ষে দুজন করে খেলোয়াড় থাকেন। মিডফিল্ডার জামাল ভূঁইয়া একাই এক কক্ষে।
ওদিকে যুব ফুটবল নিয়ে অন্যদের মতো উদাসীনতা নেই সাইফ স্পোর্টিংয়ের। এরই মধ্যে সাভার বিকেএসপির অনূর্ধ্ব-১৮ বয়সী ২৫ জন ফুটবলারের দায়িত্ব নিয়েছে সাইফ। বিকেএসপিতে ওই ছেলেদের প্রশিক্ষণ চলছে স্প্যানিশ কোচের অধীনে। ৩২ কিশোরকে নিয়ে অনূর্ধ্ব-১৬ দলও গড়ে তুলছে সাইফ। ওই দায়িত্ব পেয়েছেন রহমতগঞ্জের কোচ কামাল বাবু। বাসাবো মাঠ আর আউটার স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছে অনুশীলনও। গোটা টিম ম্যানেজমেন্টই বেতনভুক্ত।
পেশাদার ক্লাবের মতো খেলোয়াড় কেনাবেচা করার ইচ্ছে আছে সাইফের। অন্য কোনো ক্লাব এর আশপাশেও নেই। অথচ ব্যতিক্রমী উদাহরণ গড়ে সম্ভাবনাময় সাত তরুণের সঙ্গে চার বছরের চুক্তি করেছে সাইফ। এরা একটু পরিণত হলে ২০২০ বা ২০২১ সালে নিজস্ব খেলোয়াড় নিয়েই প্রিমিয়ারে দল গড়া সম্ভব মনে করছে ক্লাবটির নেতৃত্ব। বিকেএসপিতে ভালো করা খেলোয়াড়দের সঙ্গেও লম্বা সময়ের চুক্তি করা হবে।
দলটি মনে করছে, গতানুগতিক ধারার দিন শেষ। তাই দলটি এবার মৌসুম শুরুর আগেই ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করে অনুশীলন ক্যাম্প করে এসেছে কলকাতায়। স্থানীয় পরাশক্তি ইস্টবেঙ্গল যুবদলের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলেছে। ভবিষ্যতে এএফসি কাপে খেলার স্বপ্ন পূরণ করতে পারলে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা ইউরোপে ক্যাম্প করার ইচ্ছে আছে। ইউরোপ থেকে বিশেষজ্ঞ এসেছে কদিন আগে। লিগ শিরোপা জয়ের লক্ষ্যে হাইতিয়ান ফরোয়ার্ড ওয়েডসন আনসেলমেকে নিয়ে এসেছে।
ক্লাবটির আধুনিক সব অনুশীলনসামগ্রী আনা হয়েছে বিদেশ থেকে। জিপিএস ট্র্যাকিং আছে। ফুটবলাররা চোটে পড়লে ক্লাবের খরচে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা, বিনা মূল্যে মেডিকেল সুবিধা পান সাইফের ফুটবলাররা। দল ম্যাচ জিতলে বোনাস, ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের জন্য পুরস্কার—সবই আছে সাইফের।
‘ফ্যান পেজ’ও তৈরি করে সমর্থকদের জন্য বিশেষ লটারি করে পুরস্কার দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। সেই পুরস্কার হতে পারে রাশিয়া বিশ্বকাপে অন্তত ১০-১৫টি টিকিট, যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়াসহ!
খেলা না থাকলে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য বিকেএসপিতে দল পাঠিয়ে দেয় সাইফ স্পোর্টিং। খেলা থাকলে উত্তরা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন মাঠে অনুশীলন করে। আগামী বছর গাজীপুরে আবাসন ও মাঠ তৈরি করার সক্রিয় চিন্তাভাবনা আছে। একাডেমির জন্য সেখানে জমি কিনেছে ক্লাবটি।
সাইফ স্পোর্টিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দীন চৌধুরীর সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বললে অন্তত পাঁচটি নতুন উদ্যোগের কথা শোনা যায়। ঢাকার ক্লাব কর্মকর্তাদের মধ্যে যা ব্যতিক্রম। তাঁর কথা, ‘আমরা সবকিছু পেশাদার পদ্ধতিতেই করছি। সামনে আরও চমক দেখবেন।’ এখন পর্যন্ত যা করা হয়েছে, তাতেই নাকি এক বছরে ১০ কোটি টাকার ওপর খরচ হবে।
কোচের নির্দেশনায় বিকেএসপির ছেলেদের জন্য নাকি খাদ্যতালিকায় বরাদ্দ থাকে দিনে ৭-৮টি ডিম। প্রতিদিন ওই ছেলেদের মাথাপিছু প্রায় এক হাজার টাকা খাওয়ার বিল আসে। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাসহ আরও কয়েকটি ক্লাবের খেলোয়াড়দের জন্য এই বরাদ্দ ৩০০ টাকা বা এর আশপাশে। এই বিপুল খরচের টাকা তুলতে বিপণনের কাজটা সাইফ দিয়েছে তাদেরই নিজস্ব একটি প্রতিষ্ঠানকে।
এএফসি কাপে খেলতে ঢাকা আবাহনী ও মোহামেডানের পাশাপাশি এএফসি ক্লাব লাইসেন্সিং করেছে শুধু সাইফ। দেশের গণ্ডি ছাড়াতে দলটি মরিয়া। কিন্তু এ দেশে যখন-তখন খেলা বন্ধ, অনিয়ম, ক্লাবের ছলচাতুরী, বাফুফের উদাসীনতা, ব্যর্থতা...নিত্যদিনের ঘটনা। সাইফের ভয় তাই একটাই—ক্লাব সংস্কৃতির পেছনে হাঁটার চোরাবালিতে না পড়ে যেতে হয়!
আছে
প্রধান কোচ
সহকারী কোচ
গোলরক্ষক কোচ
ফিজিও
চিকিৎসা-সুবিধা
ডাক্তার
বিপণন কর্মকর্তা
নেই
ক্লাব ভবন
অনুশীলন মাঠ
কিছু সরঞ্জাম থাকলেও পূর্ণাঙ্গ জিম হয়নি
সমর্থক গোষ্ঠী
সত্যিকারের পেশাদার হওয়ার স্বপ্ন
গত বছর পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরে প্রথম নাম লিখিয়েই রানার্সআপ। প্রিমিয়ার লিগে উঠে আসতে তাই একটুও অপেক্ষা করতে হয়নি সাইফ স্পোর্টিংকে। আকাশে বিদ্যুৎ-চমকানোর মতোই আবির্ভাব নবাগত এই দলটির। পেশাদারি চর্চায় যারা শীর্ষে থাকতে চায়।
লিগ-যাত্রা
এখন পর্যন্ত পেশাদার লিগে ৮ ম্যাচ খেলে ৫ জয়, ২ ড্র ও ১ হারে পয়েন্ট তালিকার তিনে। ১৪ গোল করে খেয়েছে ৫টি।
No comments:
Post a Comment
Thank you very much.