google-site-verification: googlefee13efd94de5649.html কোরআন হাদীসের আলোকে ” মুসলিম নারীর পর্দা ” - তারুণ্যের কন্ঠস্বর

HeadLine

News Update :

Wednesday, August 13

কোরআন হাদীসের আলোকে ” মুসলিম নারীর পর্দা ”



পর্দা শব্দটি দীর্ঘকাল পর্যন্ত স্বয়ং মুসলমানদের জন্যেই অপরিচিত এবং অস্পষ্টবোধক ছিল। অবস্থা ও যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে পর্দার বিভিন্ন অর্থ বের করা হয়। সুতরাং অনেক লোক বিভ্রান্তিবশতঃ পর্দার অর্থ বলতে নারীকে অন্ধকার ঘরে বসিয়ে রাখাকে বুঝিয়েছে, যেখান থেকে নারী যেন কোথাও আসতে বা যেতে না পারে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ক্ষেত্রে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, বিয়ের পর মেয়েরা শুধু নিজের পিতৃগৃহ ছাড়া আর কোথাও যাতায়াত করতে পারতো না এবং স্বামীর গৃহ থেকেই শেষবারের মতো তার জানাযা বের হতো। এটাকে তারা তাদের পারিবারিক আভিজাত্যের প্রতীক মনে করতো এবং এটা ছিল তাদের কাছে বিশেষ প্রশংসনীয় বিষয়। এ ধরনের বিদঘুটে অবস্থায় নারী যদি কোন মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়তো তাহলে এমনকি ডাক্তারকেও রোগিনীকে দেখার অনুমতি দেওয়া হতো না। কেবল মেয়ের পিতা, ভাই এবং শ্বশুর তাকে দেখার সুযোগ পেতো। এছাড়া রোগিনীকে কেউ দেখতেও পেত না, তা কেউ ডাক্তার হোক বা কোন নিকটাত্মীয়।
কোন কোন ক্ষেত্রে এই কড়াকড়ি কিছুটা কম ছিল। সেক্ষেত্রে মেয়ে নিকটাত্মীয়দের বাড়ী যাতায়াত করতে পারতো। তবে এই আসা যাওয়ার অনুমতি ছিল শুধু রাতের বেলায় কারণ তখন তার উপর পর-পুরুষের দৃষ্টি পড়ার আশঙ্কা ছিল তুলনামূলকভাবে কম। আর ধনী পরিবারের মেয়েরা পালকি বা পশুচালিত যানবাহনে যাতায়াত করতো। কিন্তু এসব পালকি ও যানবাহনের দরজা জানালা খুব ভালো করে বন্ধ রাখা হতো। যদি দরজা জানালা না থাকতো তাহলে পুরো পালকি বা বাহনটিকে কাপড় দিয়ে মুড়ে দেওয়া হতো। 

যাই হোক, পদব্রজে হোক বা যানবাহনে উভয় অবস্থাতেই নারীকে কড়া পর্দার বিশেষ ব্যবস্থা মেনে চলতে হতো। কাপড়ের উপর আরো কাপড় ঢেকে তার পুরো অস্তিত্বটাকে এমনভাবে ঢেকে দেওয়া হতো যে, আপাদমস্তক শরীরের সবকিছুই পুরু পর্দার অন্তরালে হারিয়ে যেতো এবং পর্দাটা এতই লম্বা হতো যে, তার একটি অংশ মাটিতেই লুটোপুটি খেতো। এই কঠোর পর্দা ব্যবস্থা আজও কোথাও কোথাও পরিলক্ষিত হয়। পর্দার এই স্ব-প্রবর্তিত ব্যবস্থা শহরের ও গ্রামের ধনী ও অভিজাত লোকদের একটি ফ্যাশনে পরিণত ছিল।
সুতরাং বিখ্যাত আধুনিকতাবাদী কাসেম আমীন বেগের মতো লোকেরা যখন নারী স্বাধীনতার পতাকা তোলেন তখন সমাজে পরিচালিত এ ধরনের কঠোর পর্দা ব্যবস্থারই সমালোচনা করে একে ইসলামী শরীয়তের পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেন এবং এও বলেন, যে এটা ইসলামের নির্দেশিত মানবিক সাম্যের বিরোধী, কারণ এতে করে নারীর ব্যক্তিত্ব খর্ব হয়। এসব যুক্তির বুনিয়াদের উপর তাঁরা চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী সমাজকে নিজেদের পক্ষে দলভুক্ত করেন।

পর্দা শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ হুকুম । এ হুকুমের উপর আমল নারীর ইজ্জত সম্মান বহুগুণে বৃদ্ধি করে। দুনিয়ার জীবনে তাকে সুসংহত ও নিরাপদ করে  । পর্দা নারীর ভূষণ, নারীর পবিত্রতা, তার স্বকীয়তা, আত্মমর্যাদাবোধ, লজ্জা ও ঈমান । মুসলিম সমাজে পর্দার রেওয়াজ আছে। কিন্তু পরিপূর্ণ শরয়ী পর্দা খুবই কম । ব্যাপকভাবে পর্দার ব্যাপারে বিভিন্ন দিক দিয়ে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় । নি¤েœ এ সম্পর্কিত কিছু বিষয় তুলে ধরা হল যেন মুসলিম মা-বোনেরা পরিপূর্ণ শরয়ী পর্দা করতে সক্ষম হয় ।

চেহারাও পর্দার অন্তর্ভুক্ত



এক শ্রেণীর লোক নারীর চেহারাকে পর্দার অন্তর্ভুক্ত মনে করে না । অথচ চেহারা পর্দার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চেহারা পর্দার অন্তর্ভূক্ত না হওয়ার ব্যাপারে সূরা নূরের ৩১ নং আয়াত উল্লেখ করা হয়। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তবে যা সত্যই প্রকাশমান’। অথচ হিজাবের মূল আয়াত এটি নয়। পর্দার বিষয়ে এই আয়াত দ্বারা দলীল দেওয়া এবং এই আয়াতকেই একমাত্র দলীল মনে করা ভুল । মূলত পর্দার আয়াত হল সূরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াত ।

‘হে নবী আপনার স্ত্রী ও অন্যদেরকে এবং মুমিনদের স্ত্রীদেরকে বলুন, তারা যেন চাদর নিজেদের উপর টেনে নেয়’।

ইমাম সূয়ূতী র. বলেন, এটি সকল নারীর জন্য হিজাবের আয়াত । এতে মাথা ও চেহারা ঢাকা ওয়াজিব করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন, আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের স্ত্রীদের আদেশ করেছেন তারা যেন প্রয়োজনের মুহূর্তে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় উপর দিয়ে পর্দা ঝুলিয়ে চেহারা ঢেকে রাখে এবং শুধু এক চোখ খোলা রাখে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৩/৮২৪)

প্রখ্যাত ফকীহ তাবেয়ী উবাদা আসলামী রা. দেখিয়েছেন, কীভাবে নারীগণ এই আয়াতের উপর আমল করেন। তিনি তাঁর চাদর দিয়ে এমনভাবে মুখমন্ডল আবৃত করলেন যে, নাক ও বাম চোখ আবৃত হয়ে গেল। শুধু ডান চোখ খোলা থাকল। তদ্রƒপ মাথার উপর থেকে কপাল ও চোখের ভ্রুও আবৃত হল । তাফসীরে তাবারী, আদ্দুররুল মানসুর ৫/২২১, আহকামুল কোরআন- জাসসাস: ৩/৩৭১; তাফসীরে কাশশাফ ৩/২৭৪; আহকামুল কোরআন- ইবনুল  আরাবী ৩/১৫৮৫-১৫৮৭; যাদুল মাসীর ফী ইলমিত তাফসীর ৬/৪২২; আদ্দুররুল মানসুর ৫/২২১; আনওয়ারুত তানযীল ওয়া আসরারুত তাবীল ২/২৮০; তাফসীওে কুরতুবূ ১৪/২৪৩-২৪৪।

উল্লেখ্য, সূরা নূরের ৩১ নং আয়তে মূলত সতরের সীমারেখা বর্ণনা করা হয়েছে। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে হাত এবং মুখ খোলা রাখার তথাও বর্ণিত হয়েছে। তবে এ বর্ণনাগুলোর অধিকাংশই নেহায়েত দুর্বল । দু’একটি গ্রহণযোগ্য বর্ণনা রয়েছে। সে হিসাবে এটি এ আয়াতের একটি ব্যাখা ।

আয়াতের অন্য আরেকটি ব্যাখ্যা হল, ‘মা যাহারা মিনহা’ দ্বারা উদ্দেশ্য কাপড় । প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. এই ব্যাখ্যাই করেছেন । ইমাম ইবনে কাসীর র. এই মতকে প্রধান্য দিয়ে বলেন, হযরত হাসান, ইবনে সীরিন, আবুল জাওযা, আব্দুর রহীম নাখয়ী, হযরত ইবনে মাসঊদ রা. এর অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন।

ইবনে জাওযী র. আরো বলেন, ইমাম আহমদ র.ও  বলেছেন যে, প্রকাশ্য সৌন্দর্য হল কাপড়, আর নারীরর শরীরের সব কিছু এমনকি নখও পর্দার অন্তর্ভুক্ত । ( যাদুল মাসীর ৬/৩১)

আর ইবনে আব্বাস রা. এর ব্যাখ্যা গ্রহণ করলেও এই আয়াত পরবর্তীতে নাযিলকৃত  হিযাবের আয়াত দ্বারা মানসুখ হয়েছে । শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. সহ আরো কিছু মনীষীও এই মত পোষণ করেন।

আয়েশা রা. এর ‘ইফক’এর ঘটনায়  উল্লেখিত হাদীস নসখেন সুস্পষ্ট প্রমাণ। আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. বলেন, আমি যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তখন সফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল আমার নিকটে এসে আমাকে দেখে চিনে ফেলল। কেননা, সে আমাকে হিজাবের হুকুম নাযিল হওয়ার আগে দেখেছিলেন। সে তখন ইন্নালিল্লাহ বলল । আমি তার ইন্নালিল্লাহ বলার শব্দে জেগে উঠি । তখন আমি ওড়না দিয়ে আমার মুখ ঢেকে ফেলি’। সহীহ বুখারী ৫/৩২০; সহীহ মুসলিম হাদীস ২৭৭০; জামে তিরমিযী হাদীস ৩১৭৯) প্রকাশ থাকে যে, সাহাবায়ে কেরাম হিজাবের আয়াত নাযিল হওয়ার পর চেহারায় পর্দা করতেন, যা আম্মাজান আয়েশা রা. এর উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত । এছাড়া এ সংক্রান্ত আরো প্রমাণ পরবর্তী আলোচনায় আছে।

 এহরাম অবস্থায় মহিলারা চেহারা খোলা রাখা



অনেকে মনে করে, ইহরাম অবস্থায় চেহারার পর্দা নেই। ফলে তারা অন্য সময় পর্দা করলেও ইহরাম অবস্থায় চেহারার পর্দা করেন না। প্রকৃত বিষয় এই যে, ইহরাম অবস্থায় চেহারায় কাপড় লাগানো নিষেধ, কিন্তু পর্দা করা নিষেধ নয় । উম্মুল মুমিনীন ও একাধিক সাহাবী থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যে, তারা ইহরাম অবস্থায়ও চেহারার পর্দা করতেন । আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম । পথচারীগণ আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করত । তারা আমাদের নিকট আসলে আমরা মাথার উপর থেকে নেকাব চেহারায় ফেলে দিতাম । তারা চলে গেলে নেকাব উঠিয়ে নিতাম। ( সুনানে আবূ দাঊদ হাদীস ১৮৩৩; ফাতহুল বারী ৩/৪৭৪)

হযরত ফাতেমা বিনতে মুনযির র. বলেন, অর্থ আমরা ইহরাম অবস্থায় চেহারা আবৃত করে রাখতাম । আবূ বকর সিদ্দীক রা. এর কন্যা আসমা রা. এর সাথে আমরা ছিলাম । তিনি আমাদেরকে নিষেধ করেননি । (মুয়াত্তা মালেক: পৃঃ ২১৭২) মোটকথা, সাহাবা-তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীনের মাঝে কোন দ্বিমত ছিল না । এ ব্যাপারে তাদের মাঝে ব্যাপক আমল ছিল । এমনকি ইহরাম অবস্থায় যখন চেহারায় কাপড় লাগানো মহিলাদের জন্যও নিষিদ্ধ তখনও তারা চেহারার পর্দা করতেন ।

উম্মুল মোমেনিনদের পর্দা : 



large

সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, পুরো কোরআন শরীফে পর্দা সম্পর্কে একটিমাত্র আয়াত রয়েছে। আর এ আয়াত উম্মুল মোমেনিন অর্থাৎ প্রিয়নবীর (সাঃ) স্ত্রীদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। এর পটভূমিতে রয়েছে সেই বিখ্যাত ঘটনা যা কোরআনের ব্যাখ্যাকাররা তাঁদের তফসীর গ্রন্থসমূহে উল্লেখ করেছেন। কোরআনের পর্দা সংক্রান্ত সেই আয়াতটি হচ্ছে- ‘হে ঈমানদারগণ! নবীর গৃহসমূহে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করো না, খাবার সময়ও উকি দিও না। তবে হ্যাঁ, তোমাদেরকে যদি খেতে ডাকা হয় তাহলে অবশ্যই আসবে। যখন খাবার খেয়ে নেবে তখন চলে যাবে। কথাবার্তায় লেগে থেকো না। তোমাদের এ সব ব্যবহার নবীকে দুঃখ দেয় কিন্তু তিনি লজ্জার কারণে কিছু বলেন না, আর আল্লাহ সত্যকথা বলতে লজ্জা করেন না। নবীর স্ত্রীদের কাছে যদি তোমাদের কিছু চাইতে হয় তাহলে পর্দার পেছন থেকে চেয়ে নিও। এটা তোমাদের এবং তাদের মনের পবিত্রতার জন্যে উত্তম পন্থা। তোমাদের জন্যে এটা কখনো বৈধ নয় যে, আল্লাহর রাসূলকে দুঃখ দেবে এবং তাঁর পরে তাঁর স্ত্রীদের সাথে বিয়ে করাও বৈধ নয়। এটা আল্লাহর কাছে বিরাট পাপ। তোমরা কোন কথা প্রকাশ কর বা গোপন কর- আল্লাহ সব কথাই জানেন।” (আহ্যাব-৫৩)
এই আয়াতকেই পর্দার আয়াত বলা হয়। এই আয়াত অবতরণের অনেক আগেই শুধু ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিকোণ অনুধাবনের আলোকেই এবং আল্লাহর ওহীর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই হযরত উমর উম্মুল মোমেনীনদের পর্দার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সুতরাং হযরত উমর একাধিকবার প্রিয়নবীর কাছে উপস্থিত হয়ে অনুরোধ করেন যে, “ওগো আল্লাহর রাসূল (রাঃ)! আপনি আপনার স্ত্রীদের বলুন যে তাঁরা যেন পর্দা করেন।” কিন্তু যেহেতু আইন প্রণয়নের ব্যাপারে তিনি স্বাধীন ছিলেন না, তাই তিনি এ ব্যাপারে আল্লাহর আদেশের অপেক্ষা করেন। বোখারী-মুসলিমে হযরত আনাস বিন মালেকের বর্ণনা মওজুদ রয়েছে। তাতে রয়েছে, হযরত উমর প্রিয়নবীর সমীপে উপস্থিত হয়ে বললেন- “ওগো আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার কাছে ভালমন্দ সব রকমের লোক আসে। হয়তো ভাল হবে, যদি আপনি আপনার লোক পবিত্র স্ত্রীদের পর্দা করার আদেশ দিয়ে দেন!” ‘সুতরাং এই পর্দার আয়াত নাজিল হয় এবং এর অবতরণ সেই প্রাতঃকালে হয় যেদিন প্রিয়নবী হযরত যয়নব বিনতে জায়েদকে বিয়ে করেন।
শুধু তাই নয়। অন্য এক বর্ণনা মোতাবেক হযরত উমর-এর অভিমত ছিল- এই পর্দা সে রকমের হবে যে, কেহ যেমন তাঁদের গৃহে যাবে না তেমনি তাঁরা নিজেরাও ঘর থেকে বেরুবেন না। এমনকি কেউ যেন তাঁদের দেখতে না পায়।
হাদীসের বর্ণনায় আরো একটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। তা হচ্ছে উম্মুল মো’মেনিন হযরত সাওদাহ বিনতে জামেয়া (রাঃ) এক রাতে নিজের কোন প্রয়োজনে পর্দা সহকারে বাইরে গিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে হযরত উমরের দৃষ্টি তাঁর উপর পড়ে। যেহেতু তিনি দীঘাকৃতির ছিলেন এজন্যে হযরত উমর তাঁকে চিনে নেন এবং বলেন; “খোদার শপথ হে সাওদা (রাঃ)! আপনি আমাদের দৃষ্টি থেকে লুকোতে পারেন না। দেখেই চেনা যায়, সুতরাং আপনি বাহিরে বের হবেন না।” একথা শুনে হযরত সাওদা (রাঃ) প্রিয়নবীর (সাঃ) কাছে উপস্থিত হন এবং পুরো ঘটনা খুলে বলেন- প্রিয়নবী (রাঃ) তখন হযরত আয়েশার গৃহে নৈশভোজ গ্রহণ করছিলেন। একথা শুনে প্রিয়নবী এলহামী অবস্থায় পড়েন এবং বলেন- “তোমাদের জন্যে এই অনুমতি রয়েছে যে, তোমরা নিজেদের প্রয়োজনে বাইরে বেরুতে পারবো।” এই ঘটনা, ইমাম বোখারীর সহীহ হাদীস এবং তফসীরের বিভিন্ন গ্রন্থে যেমন তাবারী, ইবনে কাসীর এবং কুরতবীতে দেখা যেতে পারে। প্রামাণ্য দলিলের জন্যে ওসব গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করুন।)
হাফেয ইবনে হাযার ফতহুল বারীতে লিখেছেন- “পর্দার আয়াত অবতরণের পর হযরত উমর এ ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন যে, পর্দাবৃতা কোন মহিলার ব্যক্তিত্ব যেন চেনা না যেতে পারে। এ ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করেন। তাঁকে এ ধরনের বাড়াবাড়ি করতে বারণ করে দেওয়া হয় এবং উম্মুল মো’মোনিনদেরকে নিজেদের প্রয়োজনে বাইরে বেরুবার অনুমতি দেওয়া হয় যেন তাঁরা কোন অসুবিধায় না পড়েন।” উপরের বিস্তারিত বিবরণ থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, উম্মুল মো’মোনিনদের জন্যে যে ধরণের পর্দা ফরজ করা হয়েছিল তা তাদের মুখমন্ডল এবং হাতের পর্দা ছিল। তা তাঁদের পর্দাবৃত ব্যক্তিত্বের পর্দা ছিল না।
বিখ্যাত ফকীহ্ কাজী আয়াম এ প্রসঙ্গে বলেন- “এ ব্যাপারে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই যে, উম্মুল মোমোনীনদের উপর যে ধরনের পর্দা করা ফরয করা হয়েছিল তাতে মুখমন্ডল ও হাত শামিল রয়েছে। বিশেষ ক্ষেত্রেও এসব খোলা রাখার অনুমতি ছিল না- তা স্বাস্থ্যের ব্যাপারই হোক বা অন্য কিছু।”
একই দেখাদেখি অভিজাত মহলের মহিলারাও নিজেদের জন্যেও সেই ধরনের পর্দা বেছে নেন যা আল্লাহ উম্মুল মোমেনিনদের জন্যে পছন্দ করেছেন। এর উদ্দেশ্য ছিল শুধু উত্তম ব্যবহার অনুসরণ করা। অতএব, প্রিয়নবীর (সাঃ) আমল থেকেই তার অনুসরণ চলছে। কিন্তু পরবর্তী যুগে পর্দার ব্যাপারে আরো অতিরিক্ত বিধিনিষেধ ও বাড়াবাড়ির সমন্বয় ঘটে- যেমন আমরা প্রথমেই উল্লেখ করেছি। এভাবে পর্দার নামে কঠোর প্রথা সমাজে প্রচলিত হতে শুরু করে এবং এক শ্রেণীর লোক এটাকে তাদের পারিবারিক আভিজাত্যের অংশে পরিণত করে নেয়। এভাবে তাঁরা পর্দার ইসলামী উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকেই খর্ব করে। তাদের পর্দাটা ইসলামী না হয়ে একটা প্রচলিত প্রথায় পরিণত হয়ে গেছে। (সুতরাং কেউ বিয়ের পয়গাম দিয়েও নিজের হবু স্ত্রীকে দেখার অনুমতি পায় না। অথচ শরীয়তে তার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু শরীয়তের বিধানের দিকে তাদের দৃষ্টি কি থাকবে তারা তো সামাজিক প্রচলন নিয়েই বেশী মাথা ঘামায়।)
মুসলিম নারীর পর্দা : পর্দা মুসলিম নারীর সেই স্বতন্ত্র ভূষণ যা ইসলাম তার জন্যে নির্ধারিত করেছে। ইসলাম পর্দার মাধ্যমে অন্ধকার যুগের অশ্লীলতা ও দেহপ্রদর্শনী প্রথার মূলোচ্ছেদ করেছে এবং পর্দাহীন সমাজে সৃষ্ট যাবতীয় বেলেল্লাপনা ও যৌন অপরাধ প্রবণতা বন্ধ করে দেওয়ার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
এখানে ইসলামের মহৎ উদ্দেশ্য প্রমাণিত করার জন্যে এবং ইসলামী সমাজে নারীর মর্যাদা ও গুরুত্ব কার্যকরী করার জন্যে অন্ধকার যুগের কিছু ঘটনার উল্লেখ করা উচিত ছিল- যা থেকে এটা বুঝা যেতো যে, ইসলাম পর্দার ব্যবস্থা করে নারী জাতিকে কি দারুণ বিপর্যয় ও দুরবস্থা থেকে রক্ষা করেছে। এতে করে সে সব লোকদের মুখোশও উন্মোচিত হয়ে পড়তো যাঁরা নারীকে কেবল পাশবিক উল্লাসের সম্বল বলে মনে করে। কিন্তু সেসব ঘৃণ্য-জঘন্য-যৌন নোংরামীর বিস্তারিত বিবরণ পেশ করে আমরা আমাদের পাঠক-পাঠিকাদের পবিত্র মনকে তমসাচ্ছন্ন করতে চাই না। তবে অন্ধকার যুগের সামাজিক পরিবেশের একটা চিত্র তুলে ধরার জন্যে পবিত্র কোরআনে যে সব প্রয়োজনীয় আয়াত বর্ণিত হয়েছে তা অধ্যয়ন করার পরামর্শ আমরা অবশ্যই দেবো। পবিত্র-কোরআনের এসব আয়াতে অন্ধকার যুগের বিভিন্ন বদ-অভ্যাস, কুসংস্কার ও অশ্লীলতার নিন্দা ও সমালোচনা করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে প্রচলিত নোংরামীর জন্যে তাদের তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করা হয়েছে। সাথে সাথে এমন সব আইনবিধিও প্রণয়ন করা হয়েছে যার বাস্তবায়ন করে ঐসব অপরাধ প্রবণতা, নোংরামী ও অশ্লীলতা থেকে তারা মুক্তি পেতে পারে। এসব আয়াত অধ্যয়ন করলে বুঝা যাবে যে, অন্ধকার যুগে নারীর অবস্থা কত বেদনাদায়ক ছিল এবং ইসলাম কিভাবে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর আগে নারী ছিল শোষিতা, নিপীড়িতা, নির্যাতিতা। ইসলাম নারীকে পূর্ণ মানবিক মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়ে অবনতির অতল তল থেকে উন্নতি ও মর্যাদার উচ্চতম পর্যায়ে এনে আসন দিয়েছে। ইসলাম নারীকে শিক্ষাদীক্ষায় ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সমুজ্জ্বল করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে এমনকি আধ্যাত্মিকভাবেও উচ্চতর মর্যাদা দান করেছে। আগে যেখানে নারীকে মানুষ বলে স্বীকৃতি দিতেও সবাই অপ্রস্তুত ছিল, সেখানে ইসলামই শুধু তাকে পূর্ণ মানুষ বলে ঘোষণা করেছে এবং তাকে সেবা করা ও শ্রদ্ধা করাকে আল্লাহর ইবাদাতের সমতুল্য বলে ঘোষণা করেছে।
নীচে আমরা ইসলামের এমন কিছু বিশেষ মূলনীতির উল্লেখ করবো যা সামষ্টিক ও মনস্তাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে যে কোন সমাজের জন্যে অত্যন্ত মূল্যবান প্রমাণিত হবে।
*** সবচেয়ে বেশী উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, ইসলাম নারী ও পুরুষের মধ্যে যথার্থ সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ইসলামের সব বিধি-বিধানে নারী-পুরুষ উভয়কে একই গুরুত্ব দিয়ে সম্বোধন করা হয়েছে। কোরআনে একদিকে যেমন বলা হয়েছে যে-“হে নবী! মুমিন নারীদের বলুন যে, তারা নিজেদের দৃষ্টি নীচে রাখবে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করবে।” সেখানে সাথে সাথে এও বলা হয়েছে যে- “হে নবী! মুমিন পুরুষদের বলুন যে, তারা নিজেদের দৃষ্টি নীচে রাখবে এবং নিজেদের লজ্জা । স্থানকে হেফাজত করবে।” বলা বাহুল্য, পবিত্র কোরআনে নারী-পুরুষ উভয়কে একই বিষয়ে সমান গুরুত্ব দিয়ে আহ্বান জানানো হয়েছে।

 চোখ ঢাকাও পূর্ণ পর্দার অংশ



অনেকে অর্ধমুখ খোলা রাখেন । ভ্রƒর উপর থেকে নাকের অর্ধেক পর্যন্ত খোলা রাখেন । এটাও ঠিক নয় । হযরত আয়েশা রা. ও ফাতিমা বিনতে মুনযির রা. এর উপরোক্ত বর্ণনায় পূর্ণ চেহারা ঢাকার কথা আছে। এছাড়া সূরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াতের তাফসীরে হযরত ইবনে আব্বাস রা. এবং উবাদা আসলামী রা. যা বলেছেন, তা আরো স্পষ্ট যে, তিনি বাম চোখও ঢেকে নিয়েছেন। শুধু ডান চোখটি দেখার স্বার্থে বের করে রেখেছেন । আর মাথার উপর থেকে নেকাব এমনভাবে ঝুলিয়েছেন যে, চোখও ভ্রু ঢেকে আছে। আজকাল নেকাবের জন্য পাতলা কাপড় পাওয়া যায় । যা ব্যবহারে ঢেকে যায় । আবার চলাচলেরও অসুবিধা হয় না।

মাহরাম ছাড়া সফর করা



আজকাল অনেক মহিলারা দূর দূরান্ত থেকে মাহরাম ছাড়া একাকী সফর করে । দেশে এক শহর থেকে অন্য শহর এমনকি বিদেশ সফরও একাকী করে থাকে । এটা নাজায়েজ । শরীয়তের বিধান হল ৪৮ মাইল বা ততোধিকের সফর মহিলারা মাহরাম ছাড়া করবে না। অন্য মহিলাদের সঙ্গী হয়ে যায়ার ও অনুমতি নেই । অনেক মহিলারা মাহরাম ছাড়া হজ্বের সফরেও যায় । অন্য মহিলার সঙ্গী হয়ে যাওয়াকে বৈধ মনে করে । বিশেষ করে জিদ্দা থেকে কোন মাহরাম সঙ্গী হওয়ার মতো ব্যবস্থা থাকলে এবং দেশে বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিলে পথিমধ্যে একাকী সফরকে দোষনীয় মনে করা হয় না । অথচ একাকী সফর করার বাপারে হাদীস শরীফে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা এসেছে। হজ্জের সফরেও একাকী যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধ এসেছে।

(সহীহ মুসলিম ৯/১১০; সুনানে দারাকুতনী ২/২২৩)

নিয়মিত বাইরের ব্যস্ততা সমীচীন নয়



অনেক মহিলারা ঘরের বাইরের ব্যস্থতা নিয়মিত রাখে । যেমন চাকরি, স্কুল-কলেজে পড়া লেখা ইত্যাদি। নিয়মিত বাইরের ব্যস্ততা রাখা ঠিক নয়। বিশেষত একাকী যাতায়াত করা আরো খারাপ। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘তোমরা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান কর ।’

এই আয়তের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেন, অতি প্রয়োজন ছাড়া মহিলাদের বের হওয়া ঠিক নয় । আর নিয়মিত বাইরের ব্যস্ততায় ফিতনার আশংকা রয়েছে। এজন্য মসজিদের জামাতে অংশগ্রহণ করতেও নিষেধ করা হয়েছে। তাই পড়া-শুনা বা প্রয়োজনীয় কোন কাজে নিয়মতি বের হলে পূর্ণ শরঈ পর্দার সাথে মাহরামসহ বের হবে ।

 মহিলাদের একাকী বাজার করা অনুচিত



অনেক পর্দাশীল মহিলা একাকী বাজার করে । অথচ একাজগুলো বাড়ির পুরুষদের দিয়ে সুন্দরভাবে হয়ে যায়। এ কাজ মহিলাদের নিজে নিজে করা কোরআনে কারীমের আয়াত-‘তোমরা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান কর’-এর খেলাফ । দ্বিতীয়ত কেনাকাটা করতে গিয়ে দোকানী পুরুষদের সাথে সরাসরি কথাবার্তা বলতে হয়, পুরুষদের ভীড়ের মধ্য দিয়ে চলাফেরা করতে হয় । এভাবে শরীয়তের হুকুম লঙ্ঘন করা হয়। এজন্য মহিলাদের এভাবে একাকী বাজার করা অনুচিত ।

বাইরে সুগন্ধি ব্যবহার করা নাজায়েয



অনেক মহিলা বাইরে বের হওয়ার সময় পর্দা করে বের হয় বটে, কিন্তু পারফিউম বা অন্য সুগন্ধি ব্যবহার করে । মহিলাদের বাইরে বের হওয়ার সময়  সুগন্ধি ব্যবহার করা নাজায়েয। এতে পর্দা লঙ্ঘন হয় । শরঈ পর্দা আদায় হয় না  । হাদীস শরীফে ওই সব মহিলার  উপর অভিসম্পাদ করা হয়েছে যারা সুগন্ধি মেখে বের হয় ।

এক হাদীসে এসেছে, অর্থ: যে নারী সুগন্ধি ব্যবহার করে বাইরে বের হল, অতঃপর লোকদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করল যে, তারা যেন সুঘ্রাণ পায় সে ব্যভিচারিনী । (মুসনাদে আহমাদ ৪/৪১৪; মুসতাদরাকে হাকেম ২/৩৯৬; সুনানে আবূ দাঊদ ৪১৭৫)

আঁটসাঁট বোরকা পরা



কিছু মহিলা এমন বোরকা পরে যে, বোরকার উপর দিয়ে শরীরের আকার- আকৃতি বোঝা যায় । কেউ কেউ একেবারে টাইটফিট বোরকা পরে । এমন পোশাক পরে বাইরে রেব হয়, যা পরিধান করে বাইরে বের হওয়া নাজায়েয । এতে বোরকার হক আদায় হয় না । শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে উঠে এমন পোশাকে যারা বের হয় তাদেরকে হাদীস শরীফে কঠিন ভাবে সাবধান করা হয়েছে। এক হাদীসে তাদের উপর লানত করা হয়েছে। আর এক হাদীসে বলা হয়েছে, দুই শ্রেণীর লোক জাহান্নামী তার মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণী লোক হচ্ছে, ঐ সকল নারী, যারা পোশাক পরিধান করা স্বওে¦ও বিবস্ত্র । অন্যকে নিজের প্রতি আকর্ষণকারিনী ও নিজেও আকৃষ্ট। বুখতি উটের উঁচু কুঁজের মতো তাদের চুলের খোপা । এসব নারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধি অনেক দূর থেকে পাওয়া যাবে’।

আকর্ষণীয় ও কারুকার্যময় বোরকা পরিধান করা



আজকাল জাঁকজমকপূর্ণ বোরকার প্রচলন বেরেছে। বিভিন্ন ডিজাইনের আকর্ষণীয় বোরকা । এধরনের জাঁকজমকপূর্ণ আকর্ষণীয় বোরকা পরা ঠিক নয় । মহিলাদরে বাইরে বের হওয়ার একটি মূলনীতি হল, বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টিকারী কোন কিছু ব্যবহার না করা । এজন্য সুগন্ধিসহ সকল আকর্ষণ সৃষ্টিকারী বস্তু ব্যবহার নাজায়েজ । কেউ কেউ পেন্সিল হিল ব্যবহার করে । এর ব্যবহারও এড়িয়ে চলা জরুরী ।

 পুরুষদের সঙ্গে সহাবস্থান



পুরুষদের সাথে একত্রে চাকরি বা পড়া-শুনার ক্ষেত্রে বোরকা পরাকেই যথেষ্ট মনে করা হয় । অথচ গায়রে মাহরাম পুরুষের সাথে সান্নিধ্য ও তাদের সঙ্গে ওঠাবসা থেকে মহিলাদের দূরে থাকা কর্তব্য । তাই পুরুষের সহাবস্থানে শুধু বোরকা দ্বারা পর্দার হক আদায় হয় না । কেননা পর পুরুষের সাথে উঠা-বসা, লেনদেন জিনিসপত্রের আদান-প্রদান এবং অফিসিয়াল প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে অপরিচিতদের সাথে কথাবার্তা বলতে হয় ।  এতেও পর্দার খেলাফ হয় । এসকল ক্ষেত্রে বোরকা পরে থাকলেও পর্দার খেলাফ হয় । অবশ্য বোরকা পরিধানের কারণে বোরকা ছাড়া মহিলাদের চেয়ে গুনাহ কম হবে।

 অন্যদের সাথে কোমলতা প্রদর্শন ঠিক নয়



গায়রে মাহরামের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলা নিষেধ নয় । কিন্তু এক্ষেত্রেও কোমলতা বর্জন করা কোরআনের নির্দেশ। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা পর পুরুষের সাথে কোমল স্বরে কথা বলো না । ফলে সে ব্যক্তি কুবাসনা করবে যার অন্তরে ব্যধি রয়েছে।’ (সূরা আহযাব:৩২)

সুতরাং প্রয়োজনীয় কথা-বার্তার ক্ষেত্রে কোমলতা বর্জন না করাও পর্দার খেলাফ। আর প্রয়োজন ছাড়া গায়রে মাহরামের সাথে কথা না বলাই কাম্য। বিশেষ কোন ফেতনার আশংকা থাকলে কথা বলা জায়েয হবে না। (শরহে মুসলিম- নববী কৃত ২/১২১আদ্দুররুল মুখতার ১/৪০৬; আল মুফাসসাল৩/২৭৬)

 শরঈ পর্দার শর্তাবলি



শর্তগুলো উপরে বিক্ষিপ্তভাবে এসেছে সহজকরণের লক্ষে তা সংক্ষিপ্তভাবে আবারো প্রদত্ত হল। অনেক মা-বোনই পর্দা করে কিন্তু অনেকে জানেনই না পূর্ণ পর্দা কাকে বলে? এর জন্য কি কি শর্ত রয়েছে? তাই পূর্ণ পর্দার শর্তাবলি উল্লেখ করা হল।

১.কোন প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া। এক্ষেত্রে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পূর্ণ শরীর আবৃত করা, মুখ ও চোখের উপর নেকাব রাখা, হাত মোজা ও পা মোজা পরিধান করা।

২.বোরকার কাপড় ভালো ও শালীন হওয়া, আকর্ষণীয় কারুকাজ ও নকশা না থাকা। অর্থাৎ বোরকা আকর্ষণীয় না হওয়া। আজকাল বিভিন্ন প্রিন্টের বোরকা পাওয়া যায় যথা সম্ভব এ থেকে এড়িয়ে থাকা। তদ্রƒপ কালো কাপড়ের উপর আকর্ষণীয় কাজও যেন না হয়।

৩.বোরকার কাপড় মোটা হওয়া। এমন পাতলা না হওয়া যে, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ  দেখা যায়।

৪.অধিক ঢিলাঢালা বোরকা হওয়া। এমন আঁটসাঁট না হওয়া যে, বোরকা শরীরের সাথে লেগে থাকে কিংবা পরিধানের পর শরীরের কোন অঙ্গ প্রকাশ পায়।

৫.বাইরে বের হওয়ার সময় সুগন্ধি ব্যবহার না করা। এটাও শরঈ পর্দার অংশ।

৬.এমন অলংকার পরে বাইরে না যাওয়া, যা পরিধান করে চললে আওয়াজ হয়। যেমন-নুপুর, কাঁচের চুড়ি ইত্যাদি।

৭.চিকন ও লম্বা হিল বিশিষ্ট জুতাপরিধান না করা। যেন চললে স্বাভাবিকতা বজায় থাকে।

৮.উঁচু করে খোপা বা চুল না বাঁধা।

৯.গায়রে মাহরামের সাথে অপ্রয়োজণীয় কথা বলা ও সালাম দেওয়া-নেওয়া থেকে বিরকত থাকা। প্রয়োজনে বলতে হলে কোমলতা পরিহার করা।

১০.সফরসম দূরত্বে কিংবা ফেতনার আশংকা থাকলে মাহরাম পুরুষের সঙ্গে যাওয়া।

মহিলাদের নাম সতর নয়



কেউ কেউ মনে করে মহিলাদের নামের পর্দা আছে। পর পুরুষের সামনে বলা গুনাহ । এধারণা ঠিক নয়। এতে গুনাহ নেই । তবে মহিলাদরে নাম অন্যকে বিনা প্রয়োজনে না বলাই ভালো। ফিতনামুক্ত থাকার জন্য এটি সহায়ক হতে পারে।

 চাচী, মামী ও ভাবীর সঙ্গে পর্দা করা আবশ্যক



কেউ কেউ মনে করে চাচী, ভাবী, মামী এ ধরনের গায়রে মাহরাম আত্মীয়দের সাথে দেখা দেয়া যায়। বিশেষত যখন তাদের কাছেই বড় হয় কিংবা তারা বয়স্কা হয়ে যান। কিন্তু যেহেতু ইসলামে তাঁদের সঙ্গেও পর্দার বিধান রয়েছে তাই শুধু উপরোক্ত যুক্তিতে দেখা জায়েয হবে না।  সর্বাবস্থায় তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হারাম।

 উকিল বাবার সাথে পর্দা করা আবশ্যক



বিয়ের সময় যাকে উকিল বানানো হয় তাকে সমাজে পাত্র-পাত্রীর উকিল বাবা বলা হয়। তার সাথে পরবর্তীতে অবাধে দেখা-সাক্ষাত করা হয়। এমনকি মাহরামের অন্তর্ভুক্তও মনে করা হয়। এটা সম্পূর্ণ ভুল। গায়রে মাহরামকে উকিল বানানো হলেও তার সাথে দেখা-সাক্ষাত পূর্বের মতোই হারনাম।

 ধর্মের বোন ডাকা ও পর্দা না করা



অনেকে বিভিন্ন অজুহাতে গায়রে মাহরাম মহিলাকে বোন ডাকে। সমাজে একে ‘ধর্মের বোন’ বলে  অভিহিত করা হয়। ধর্মের বোনের সাথে আপন বোনের মতোই আচরণ করা হয়  পর্দা করা হয় না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মীরাসও দেওয়া হয়। গায়রে মাহরাম মহিলার সাথে এ ধরনের সম্পর্ক বৈধ নয়। ধর্মের বোন বলতে যা বোঝানো হয় শরীয়তে তা স্বীকৃত নয়। তাদের পরস্পর দেখা-সাক্ষাত নাজায়েয।

মহিলাদের মসজিদে গমন



কিছু কিছু পর্দাশীন নারী মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করে থাকে। বিশেষত জুমআ পড়ে থাকে। এভাবে মসজিদে গিযে নামায আদায় করলে নামায হয়ে যাবে কিন্তু তাদের জন্য মসজিদে শরীক হয়ে নামায পড়া মাকরুহ।

(ফাতাওয়া শামী ১/৫৬৬; বাদায়েউস সানায়ে ১/৬১৭১/৩৮৮)

মহিলাদের মসজিদে যাওয়াকে রাসূল সা. নিরুৎসাহিত করেছেন। (মুসনাদে আহমাদ ৬/৩৭১)

পরবর্তীতে আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. সহ অনেক সাহাবী  মহিলাদের মসজিদে যেতে নিষেধ করেছেন। সহীহ বোখারী ১/১২০; সহীহ মুসলিম১/১৮৩ মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা ৫/২২-২০৩)

মহিলাদের মসজিদে নামায আদায়ের মধ্যে বিশেষত বর্তমান যুগে পর্দার হক আদায় হয় না।

মাহরাম পুরুষের সামনে সতরের ব্যাপারে উদাসীনতা



আমাদের দেশে মহিলাদের অনেকে শাড়ী পরে থাকে। এতে অনেক সময় পেট ও পিঠ খোলা থাকে ঘরে মাহরাম পুরুষের সামনে একে গুনাহ মনে করা হয় না। অথচ এর দ্বারা সতর খোলার গুনাহ হয়। মহিলাদের পেট-পিঠ সতরের অন্তুর্ভুক্ত। মাহরাম পুরুষের সামনেও তা ঢেকে রাখা ফরয।

 জাহেলী যুগের মতো ওড়না ব্যবহার



জাহেলী যুগে ওড়না ব্যবহারের নিয়ম ছিল, নারীরা মাথায় ওড়না দিয়ে তার দুই প্রান্ত পৃষ্ঠদেশে ফেলে রাখত। ফলে গলা ও বক্ষদেশ অনাবৃত থাকত। ইসলামের প্রথমযুগে আল্লাহ তা‘আলা জাহেলী যুগের এই কু-প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। কোরআন মজীদে এসেছে-‘তারা যেন বক্ষদেশে ওড়না ফেলে রাখে’ (সূরা নূর;৩১)

আম্মাজান  হযরত আয়েশা রা. বলেন, যখন এই আয়াত নাযিল হয়, তখন (তৎক্ষণাৎ আমলের জন্য মহিলা সাহাবিগণ নিজেদের-পেটিকোট) নিয়ে তার পাশ থেকে কেটে তা ওড়না রূপে পরে নেয়।’ (সহীহ বুখারী ৮/৩৪৭)

বর্তমান জাহেলীযুগ পূর্বের জাহেলী যুগও ছেড়ে গেছে। অতি আধুনিক মেয়েরা তো ওড়না ব্যবহারই করে না। কেউ কেউ ব্যবহার করলেও জাহেলী যুগের মতো গলাও বক্ষদেশ খোলা রাখে। সুতরাং ঘরে-বাইরে সর্বত্র মহিলাদের ওড়না পরিধানের নিয়ম এটিই। এমনকি ফাতাওয়া শামীতে ঘরের মাহরামদের সামনে মহিলাদের মাথায় কাপড় রাখাকে মুস্থাহাব বলা হয়েছে। (ফাতাওয়ায়ে শামী: ১/৪০৪)

 পালক সন্তানের সাথে পর্দা করা



পালক সন্তান আপন সন্তানের মতো নয়। তার সাথে পর্দা করা ফরজ। হ্যাঁ, সন্তানের দুই বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে যদি নিজের বুকের দুধ খাওয়ায়  সেক্ষেত্রে সন্তানও হয়ে যায়। আর দুধ সন্তানের সাথে দেখা দেওয়া জায়েয । দুধ পান না করিয়ে থাকলে পালক সন্তানের সাথে দেখা দেয়া জায়েয হবে না। পালক সন্তান নিজের সন্তানের মতো নয়  তা সূরা আহযাবের ৪ও৫নং আয়াতে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে।

 মেয়েদের পর্দার বয়স



অনেকে মনে করে ¯্রাব না দেখা দেয়া পর্যন্ত পর্দার বয়স হয় না। এই ধারণা ঠিক নয়। মেয়েরা বড় হয়ে ওঠলেই পর্দার বয়স শুরু হয়ে যায় । ফাতাওয়ায়ে শামীসহ অন্যান্য ফাতাওয়া গ্রন্থে নয় বছর অতিক্রম করলেই পর্দার বয়স হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাই এই বয়স থেকেই পর্দা করা জরুরূ।

(ফাতাওয়ায়ে শামী:১/৪০৮;৩.৩৭ আহসানুল ফাতাওয়া :৮/৩৮)

ছেলেদের পর্দার বয়স



ছেলেদের যখন নারীদের সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন হতে আরম্ভ করে তখন থেকেই তার সঙ্গে পর্দা করতে হবে। সূরা নূরের ৩১নং আয়াতে এসেছে তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে কিন্তু তাদের স্বামীর নিকট অথবা যৌন কামনামুক্ত পুরুষ ও বালক যারা নারীদের আবৃত অঙ্গ-প্রতঙ্গ সম্পর্কে সচেতন নয়।” (সূরা আন নূর ৩১)

এই চেতনা সাধারণত কত বছর বয়সে হয় এ নিয়ে ফকীহগণের বিভিন্ন মত আছে। ইমাম আহমদ র. সহ অনেকেই দশ বছর বলেছেন। তবে ফাতাওয়া শামীতে বয়োপ্রাপ্তির ন্যূনতম সীমা ১২ বছর বলা হয়েছে। সুতরাং ছেলের ১২ বছর বয়স হলেই তার সাথে নারীদের পর্দা করতে হবে। তবে দশ বছর বয়স থেকেই শুরু করা ভাল।

প্রসঙ্গত বর্তমানে এ বিষয়ে অনেক বেশী সতর্ক ও সচেতন হওয়া উচিত। ফাতাওয়ায়ে শামী : ৩/৩৫; আলমুফাসসাল: ৩/১৮০-১৮১)

মেয়েদের সাথে মেয়েদের পর্দা



অন্য নারীর সামনে একজন নারীর সতর নাভী থেকে হাটু পর্যন্ত । এ অংশ কোন বিশেষ ওযর ছাড়া কোন নারীর সামনেও খোলা জায়েয নয়। আর পেট, পিঠ, বুক এগুলোও প্রয়োজন ছাড়া অন্য নারীর সামনে অনাবৃত করা অনুচিত। আর ফিতনার আশংকা হলে তা আবৃত রাখা জরুরী। ( আল মুফাসসাল: ৩/২৬৫; ফাতাওয়া শামী: ৬/৩৭১)

বিধর্মী নারীর সাথে মুসলিম নারীর পর্দা না করা গুনাহ



বিধর্মী নারীর সামনে মুখ, হাত ও পা ছাড়া পুরো শরীর এমনকি চুলও ঢেকে রাখা জরুরী। তাদের সামনে শরীরের সৌন্দর্য প্রকাশ করা গুনাহ। (ফাতাওয়ায়ে শামী: ৬/৩৭১; ইমদাদুল ফাতাওয়া: ৪/১৯৬)

পুরুষদের প্রতি নজর করা



এ প্রসঙ্গে সূরা নূরের ৩১ নং আয়াত স্মরনীয়। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, অর্থ-‘হে নবী! আপনি মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন দৃষ্টিকে অবনত রাখে।’অর্থাৎ পর পুরুষের দিকে না তাকায়। হযরত উম্মে সালমা রা. বলেন, আমি রাসূল সা. এর কাছে ছিলাম, হযরত মায়মুনা রা. ও ছিলেন। ইতিমধ্যে অন্ধ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম এলেন। এটা ছিল হেজাবের হুকুম নাযিল হওয়ার পরের ঘটনা। তখন নবী কারীম সা. ইরশাদ করলেন.

অর্থ: তোমরা দু’জন তার থেকে পর্দা কর। আমরা বললাম, সে তো অন্ধ। আমাদেরকে দেখছে না এবং আমাদেরকে চিনেও না। তখন তিনি বললেন, ‘তোমরাও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখতে পাচ্ছ না? (সুনানে আবূ দাঊদ হাদীস ৪১১২)

উক্ত আয়াতও হাদীসের আলোকে ফকীহগণ বলেন, কুনজরে পুরুষের দিকে তাকানো মহিলাদের জন্য নাজায়েয। তদ্রƒপ আকর্ষণ সৃষ্টি হয় এমন গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করাও নিষেধ। আর কোন ধরনের ফিতনার আশংকা না হলে সাধারণ দৃষ্টিতে পর পুরুষের দিকে তাকানো নাজায়েয নয়। তবে এক্ষেত্রে না তাকানোই ভালো। (ফাতাওয়া শামী: ৬/৩৭১; ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: ৫/২২৭; আল মুফাসসাল: ৩/২২৭; জামেউ আহকামিন নিসা: ৪/২৮৩; বেহেশতী জেওর: ৩/৬৫)

 পুরুষদের নিকট গায়রে মাহরাম নারীদের সৌন্দর্য বর্ণনা করা



একাধিক হাদীসে গায়রে মাহরাম নারীর সৌন্দর্য বর্ণনা করতে নিষেধ  করা হয়েছে। এতেও নারীর পর্দার এক প্রকার লঙ্ঘন আছে। সাধারণত মেয়েরা তার স্বামী, ভাই ইত্যাদির কাছে গায়রে মাহরাম মহিলাদের সৌন্দর্য গুণাবলি বর্ণনা করে থাকে। যেমন- কোন পর্দাশীন মেয়েদের সাথে সাক্ষাৎ হলে, নতুন করে তার কথা বলে ইত্যাদি। এটি গুনাহ । এর দ্বারাও এক প্রকার পর্দার লঙ্ঘন হয়। হাদীস শরীফে এসেছে, নারীগণ যেন পরস্পর এ ইদ্দেশ্যে একত্রিত না হয় যে, স্বামীর কাছে অন্যদের গুণাবলি এমনভাবে বলবে যেন সে ঐ মহিলাকে দেখছে। (ফাতহুল বারী: ৯/৩৩৮; জামিউল আহকামিন নিসা : ৪/৩৩৭)

 দলিলের ভিত্তিতে প্রমানঃ 



হাদীছ থেকে দলীল :
প্রথম দলীল : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
إِذَا خَطَبَ أَحَدُكُمُ امْرَأَةً فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَّنْظُرَ إِلَيْهَا إِذَا كَانَ إِنَّمَا يَنْظُرُ إِلَيْهَا لِخِطْبَتِهِ وَإِنْ كَانَتْ لاَ تَعْلَمُ-
‘যখন তোমাদের কেউ কোন মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে, তখন তাকে দেখাতে কোন গুনাহ হবে না। তবে কেবল বিয়ে করার উদ্দেশ্যেই দেখতে হবে, যদিও মেয়ে জানতে না পারে’ [মুসনাদ আহমাদ হা/২৩৬৫০-৫১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৭।]

অত্র হাদীছে দলীল গ্রহণের দিক হ’ল নবী করীম (ছাঃ) বিশেষভাবে বিয়ের প্রস্তাব দানকারীর জন্য প্রস্তাবিত মেয়ের প্রতি তাকানোকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করেননি। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বিয়ের প্রস্তাবকারী ব্যতীত অন্য কেউ কোন অপরিচিতার দিকে তাকালে সর্বাবস্থায় পাপী হবে। অনুরূপভাবে প্রস্তাবকারী বিয়ের প্রস্তাব ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে তাকালে যেমন আনন্দ ও মজা পাওয়া বা অনুরূপ কোন কারণে তাকালে পাপী হিসাবে গণ্য হবে। যদি কেউ বলে কোন্ অঙ্গের প্রতি তাকাবে এটা তো হাদীছে বর্ণিত হয়নি। সুতরাং এর দ্বারা মেয়ের গ্রীবা ও বক্ষদেশের প্রতি তাকানো অর্থ হ’তে পারে? উত্তরে বলব, এ কথা সকলে জানে যে প্রস্তাবকারীর মূল উদ্দেশ্য মেয়ের সৌন্দর্য দেখা। আর সেটা হ’ল চেহারার সৌন্দর্য। এছাড়া তার অনুগামী অন্যান্য অঙ্গগুলির প্রতি অধিকাংশ সময় লক্ষ্য করা হয় না। প্রস্তাবকারী কেবল চেহারার দিকে তাকায়; কারণ সৌন্দর্য পিয়াসীর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্দেহাতীতভাবে সেটাই। (অতএব মুখমন্ডল পর্দার অন্তর্গত)।

২য় দলীল :
عَنْ أُمِّ عَطِيَّةَ قَالَتْ أَمَرَنَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ نُخْرِجَهُنَّ فِىْ يَوْمِ الْفِطْرِ وَالنَّحْرِ. قَالَ قَالَتْ أُمُّ عَطِيَّةَ فَقُلْنَا أَرَأَيْتَ إِحْدَاهُنَّ لاَ يَكُوْنُ لَهَا جِلْبَابٌ قَالَ فَلْتُلْبِسْهَا أُخْتُهَا مِنْ جِلْبَابِهَا-
উম্মে আতিয়া (রাঃ) বলেন, যখন নবী করীম (ছাঃ) নারীদেরকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার ছালাতে বের হওয়ার নির্দেশ দিলেন। উম্মু সালমা বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যদি আমাদের মধ্যে কারো চাদর না থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তার বোন তাকে চাদর পরাবে’ [মুসলিম হা/৮৯০; ইবনু মাজাহ হা/১৩০৭।]

অত্র হাদীছ প্রমাণ বহন করে যে, মহিলা ছাহাবীদের অভ্যাস ছিল যে, তাঁরা বড় চাদর না পরে বাইরে বের হ’তেন না। চাদর না থাকলে বের হওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভবও হ’ত না। আর এজন্য তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট তাঁদের প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করলেন, যখন তাদের ঈদের ছালাতে বের হ’তে বলা হ’ল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্য মুসলিম বোনের চাদর পরে ঈদগাহে গমন করতে বলে এ প্রশ্নের সমাধান দিলেন। কিন্তু তাঁদেরকে চাদর ছাড়া বের হওয়ার অনুমতি দেননি, যদিও ঈদগাহে ছালাত আদায়ের জন্য বের হওয়া নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য শরী‘আত সম্মত।
অতএব যখন নারীদের চাদর পরিধান ব্যতীত শরী‘আত সম্মত স্থানে যাবার অনুমতি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দিলেন না, তখন চাদর পরিধান ছাড়া শরী‘আত অননুমোদিত স্থানে যাওয়ার অনুমতি তিনি কি করে দিতে পারেন, যেখানে যেতে তারা বাধ্য নয়? বরং তা হ’ল কেবল বাজারে ঘুরা-ফিরা, পুরুষদের সাথে মিলা-মিশা ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করা, যাতে কোন উপকারিতা নেই। আর চাদর পরার নির্দেশই মুখমন্ডল পর্দা করার প্রমাণ বহন করে। আল্লাহই অধিক অবগত।

৩য় দলীল :
عَائِشَةَ قَالَتْ لَقَدْ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يُصَلِّى الْفَجْرَ، فَيَشْهَدُ مَعَهُ نِسَاءٌ مِنَ الْمُؤْمِنَاتِ مُتَلَفِّعَاتٍ فِىْ مُرُوْطِهِنَّ ثُمَّ يَرْجِعْنَ إِلَى بُيُوْتِهِنَّ مَا يَعْرِفُهُنَّ أَحَدٌ-
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফজরের ছালাত পড়াতেন। আর মুমিন মহিলাগণ সর্বাঙ্গ চাদরে ঢেকে নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে ফজরের ছালাতে উপস্থিত হ’তেন। অতঃপর ছালাত শেষ করে তারা যার যার বাড়িতে ফিরে যেতেন, আধারের কারণে তাদেরকে চেনা যেত না।[বুখারী হা/৩৭২]

আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমরা এখন নারীদের যে অবস্থায় দেখছি, যদি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ অবস্থায় তাদের দেখতেন, তাহ’লে তাদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করতেন, যেভাবে বনু ইসরাঈলের নারীদের নিষেধ করা হয়েছিল।[মুসলিম হা/৪৪৫; আহমাদ হা/২৪৬৪৬]

ইবনে মাসঊদ (রাঃ) থেকেও এরূপ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীছ দ্বারা দু’ভাবে দলীল গ্রহণ করা যায়-
(ক) পর্দা করা মহিলা ছাহাবীদের অভ্যাস ছিল, যাঁরা ছিলেন উত্তম যুগের, আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানী, শিষ্টাচারী, সৎচরিত্রবান, পূর্ণ ঈমানদার ও সৎআমলকারিণী। তাঁরা সৎ ও শ্রেষ্ঠ ছিলেন, যাঁদের প্রতি ও তাঁদের উত্তম অনুসারীদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَالسَّابِقُوْنَ الأَوَّلُوْنَ مِنَ الْمُهَاجِرِيْنَ وَالأَنصَارِ وَالَّذِيْنَ اتَّبَعُوْهُمْ بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُواْ عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ تَحْتَهَا الأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا أَبَداً ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ-
‘মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে, এটা মহা সাফল্য’ (তওবাহ ১০০)।  

মহিলা ছাহাবীদের পথ চলা যদি এমনটি হয়, তাহ’লে আমাদের জন্য কী করে সমীচীন হবে উক্ত পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া? যে পথের পথিক ও তাদের একনিষ্ঠ অনুসারীদের জন্য আল্লাহর সন্তোষ রয়েছে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيْراً- ‘কারো নিকট সৎ পথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যে দিকে সে ফিরে যায় সে দিকেই তাকে ফিরিয়ে দিব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব, আর তা কত মন্দ আবাস’ (নিসা ১১৫)।

(খ) উম্মুল মুমিনীন আয়েশা ও আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) যাঁরা ইলম ও ফিক্বহে ছিলেন দক্ষ, ধর্মীয় জ্ঞানে ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এবং আল্লাহর বান্দাদের ব্যাপারে ছিলেন নছীহতকারী। তাঁরা বলছেন যে, বর্তমান নারীদের অবস্থা দেখলে রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে মসজিদে ছালাত আদায় করতে যেতে অবশ্যই নিষেধ করতেন।[মুসলিম হা/৪৪৫; আহমাদ হা/২৪৬৪৬]

অথচ সেটা ছিল উত্তম যুগ, সে যুগেও নবী করীম (ছাঃ)-এর যামানায় যে অবস্থা ছিল তা পরিবর্তিত হয়ে মাহিলাদের মসজিদে গমন নিষিদ্ধের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। তাহ’লে ১৩ শতাব্দী পরে এসে আমাদের যুগের অবস্থা কেমন হয়েছে? এযুগে সবকিছুর ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, লজ্জাশীলতা কমে গেছে এবং অধিকাংশ মানুষের অন্তরে ধর্মীয় অনুভূতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর আয়েশা ও ইবনে মাসঊদ (রাঃ) উভয়ে শরী‘আতের দলীল যে বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছে তা পূর্ণাঙ্গরূপে বুঝেছিলেন যে, প্রত্যেক কাজ যা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে তা নিষিদ্ধ।

৪র্থ দলীল :
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ جَرَّ ثَوْبَهُ خُيَلاَءَ لَمْ يَنْظُرِ اللهُ إِلَيْهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ. فَقَالَتْ أُمُّ سَلَمَةَ فَكَيْفَ يَصْنَعْنَ النِّسَاءُ بِذُيُوْلِهِنَّ قَالَ يُرْخِيْنَ شِبْرًا. فَقَالَتْ إِذًا تَنْكَشِفَ أَقْدَامُهُنَّ. قَالَ فَيُرْخِيْنَهُ ذِرَاعًا لاَ يَزِدْنَ عَلَيْهِ-
ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গর্বভরে তার কাপড় হেঁচড়িয়ে চলে ক্বিয়ামত দিবসে আল্লাহ তার দিকে (রহমতের দৃষ্টিতে) তাকাবেন না’, উম্মে সালমা বললেন, তাহ’লে মহিলারা তাদের অাঁচল কী করবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘এক বিঘত ঝুলিয়ে পরবে’, উম্মে সালমা বললেন, তবে তো তাদের পা প্রকাশ হয়ে পড়বে। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘এক হাত ঝুলিয়ে দিবে, তার থেকে বেশি করবে না’।[তিরমিযী হা/১৮৩৫; নাসাঈ হা/৫৩৩৬]

এ হাদীছ মহিলাদের পা ঢেকে রাখা ওয়াজিব হওয়ার দলীল। আর এটা মহিলা ছাহাবীদের নিকট খুবই পরিচিত ও জানা ছিল। নিঃসন্দেহে দু’পায়ের গোড়ালী খোলা রাখার ফিতনা, মুখমন্ডল ও দু’কব্জি খোলা রাখার তুলনায় নগণ্যতর। সুতরাং নগণ্য ফিতনার ক্ষেত্রে হুঁশিয়ার করার মাধ্যমে বড় ফিতনা ও হুকুমের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠতর বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। আর শরী‘আতের হেকমত হচ্ছে ছোট বা হালকা ফিতনায় বিধান হালকা করা এবং গুরুতর ফিতনার ক্ষেত্রে কঠিন করা। এর বিপরীত করলে সেটি হবে আল্লাহর হেকমত ও শরী‘আতের মধ্যে দন্দ্ব সৃষ্টি করা।

৫ম দলীল :
قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا كَانَ لإِحْدَاكُنَّ مُكَاتَبٌ وَكَانَ عِنْدَهُ مَا يُؤَدِّى فَلْتَحْتَجِبْ مِنْهُ-
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যদি কোন নারীর নিকট চুক্তিবদ্ধ দাস থাকে আর তার চুক্তিকৃত অর্থ পরিশোধের সামর্থ্য থাকে, তাহ’লে সে নারী তার থেকে পর্দা করবে’ [ইবনু মাজাহ হা/২৬১৬; আবু দাউদ হা/৩৯২৮]

এ হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণের দিক হ’ল, মনিব নারী তার দাসের সামনে ততক্ষণ মুখ খোলা রাখতে পারবে, যতক্ষণ সে তার মালিকানাধীন থাকবে। যখন তার মালিকানার বাইরে চলে যাবে, তখন তার থেকে পর্দা করা ওয়াজিব হবে। কারণ সে তখন পরপুরুষে পরিণত হয়ে গেল। অতএব পরপুরুষ থেকে নারীর পর্দা করা আবশ্যক সাবস্ত হ’ল।

৬ষ্ঠ দলীল :
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ الرُّكْبَانُ يَمُرُّوْنَ بِنَا وَنَحْنُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُحْرِمَاتٌ فَإِذَا حَاذَوْا بِنَا سَدَلَتْ إِحْدَانَا جِلْبَابَهَا مِنْ رَأْسِهَا عَلَى وَجْهِهَا فَإِذَا جَاوَزُوْنَا كَشَفْنَاهُ-
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদের নিয়ে আরোহী অতিক্রম করছিল, আর আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে মুহরিম ছিলাম। যখন আরোহী আমাদের বরাবর হ’ত, তখন আমাদের প্রত্যেকে স্ব স্ব চাদর মাথার দিক দিয়ে চেহারার উপর ঝুলিয়ে দিত। অতঃপর যখন তারা আমাদের অতিক্রম করত, তখন আমরা চাদর সরিয়ে ফেলতাম।[আবু দাঊদ হা/১৫৬২; মিশকাত হা/২৬৯০]

আয়েশা (রাঃ)-এর উক্তি ‘আরোহীরা যখন আমাদের বরাবর হ’ত তখন আমাদের প্রত্যেকে মুখমন্ডলের উপর তার চাদর ঝুলিয়ে দিত’, এটি চেহারা ঢাকা আবশ্যক হওয়ার বড় দলীল। কেননা ইহরাম অবস্থায় চেহারা খুলে রাখা শরী‘আত সম্মত। যদি মুখ খুলে রাখার ব্যাপারে শক্তিশালী নিষেধাজ্ঞা না থাকত, তাহ’লে চেহারা খুলে রাখা ওয়াজিব হ’ত আরোহীদের সামনেও।
উপরোক্ত আলোচনা সুস্পষ্ট। অধিকাংশ আলেমের নিকটে ইহরাম অবস্থায় নারীর চেহারা খুলে রাখা ওয়াজিব। আর ওয়াজিব বিষয়ই কেবল অন্য ওয়াজিব বিষয়ের মুকাবেলা করতে পারে। সুতরাং যদি পরপুরুষের নিকট নারীর পর্দা করা ও চেহারা ঢাকা ওয়াজিব না হ’ত, তাহ’লে ইহরাম অবস্থায় মুখমন্ডল খোলার মতো ওয়াজিব কাজ ত্যাগ করার অনুমোদন দেওয়া হ’ত না।
বুখারী ও মুসলিম সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে আছে, إِنَّ الْمَرْأَةَ المُحْرِمَةَ تُنْهَى عَنْ النِّقَاب وَالْقُفَّازَيْنِ ‘মুহরিম নারীগণকে হাতমোযা ও নিকাব পরা থেকে নিষেধ করা হয়েছে’, শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, এটা প্রমাণ করে যে, নিকাব ও হাতমোযার ব্যবহার মহিলাদের মধ্যে খুবই প্রসিদ্ধ ছিল, যারা মুহরিম ছিলেন না। এর দ্বারা তাদের চেহারা ও হাতসমূহ ঢেকে রাখার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে।[বুখারী ৪/৪২, নাসাঈ ২/৯-১০, বায়হাক্বী ৫/৪৬-৪৭, আহমাদ ৬০০৩]

হাদীছের উল্লিখিত এ ছয়টি দলীল মহিলাদের পর্দা করা ও পরপুরুষ থেকে মুখমন্ডল ঢাকা ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ। এর সাথে আমি কুরআনের চারটি দলীল সংযুক্ত করেছি। যাতে কিতাব ও সুন্নাতের দশটি দলীল হ’ল।

[এতদসঙ্গে হাদীছ থেকে আরো কিছু দলীল অনুবাদক কর্তৃক সংযোজিত হ’ল]

(1) عَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِيْ بَكْرٍ الصِّدِّيْقِ قَالَتْ كُنَّا نُغَطِّيْ وُجُوْهَنَا مِنَ الرِّجَالِ، وَكُنَّا نَمْتَشِطُ قَبْلَ ذَلِكَ فِي الاِحْرَامِ-
(১) আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) বলেন, আমরা পুরুষদের হ’তে আমাদের চেহারা ঢেকে রাখতাম এবং ইহরামের পূর্বে চিরুনী করতাম।[হাকিম ১/৪৫৪; ইরওয়া হা/১০২৩; ছহীহ ইবনু খুযাইমা হা/২৬৯০]

(২) عَنْ صَفِيَّةَ بِنْتِ شَيْبَةَ قَالَتْ رَأَيْتُ عَائِشَةَ طَافَتْ بِالْبَيْتِ وَهِيَ مُنْتِقَبَةٌ-
(২) ছাফিয়্যাহ বিনতে শায়বাহ বলেন, আমি আয়েশা (রাঃ)-কে নিকাব পরিহিত অবস্থায় কা‘বা ঘর তওয়াফ করতে দেখেছি।[ইবনু সা‘দ ৮/৪৯]

(3) عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ لَمَّا اجْتَلَى النَّبِيُ صلى الله عليه وسلم صَفِيَّةَ رَأَى عَائِشَةَ مُنْتَقِبَةً وَسْطَ النَّاسِ فَعَرَفَهَا-
(৩) ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন নবী করীম (ছাঃ) ছাফিয়্যাহকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তখন তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে মানুষের মাঝে নিকাব পরিহিত দেখে চিনতে পারলেন।[ইবনে সা‘দ ৮/৯০, ইবনে আসাকির]

(4) عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها زَوْجِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ …. فَبَيْنَا أَنَا جَالِسَةٌ فِىْ مَنْزِلِىْ غَلَبَتْنِىْ عَيْنِىْ فَنِمْتُ، وَكَانَ صَفْوَانُ بْنُ الْمُعَطَّلِ السُّلَمِىُّ ثُمَّ الذَّكْوَانِىُّ مِنْ وَرَاءِ الْجَيْشِ، فَأَدْلَجَ فَأَصْبَحَ عِنْدَ مَنْزِلِىْ، فَرَأَى سَوَادَ إِنْسَانٍ نَائِمٍ، فَأَتَانِىْ فَعَرَفَنِىْ حِيْنَ رَآنِىْ، وَكَانَ يَرَانِىْ قَبْلَ الْحِجَابِ، فَاسْتَيْقَظْتُ بِاسْتِرْجَاعِهِ حِيْنَ عَرَفَنِىْ فَخَمَّرْتُ وَجْهِىْ بِجِلْبَابِىْ

(৪) আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি আমার তাবুতে ছিলাম, আমার চক্ষু আমার উপর প্রভাবিত হ’ল, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ছাফওয়ান বিন মু‘আত্তাল আস-সুলামী সৈন্যদের পিছনে লক্ষ্য রাখছিল। সৈন্যরা রাত্রের প্রথম প্রহরে চলে আসল। তিনি আমার তাবুর নিকট সকাল করলে দেখতে পেলেন ঘুমন্ত কালো একজন মানুষ। অতঃপর তিনি আমার নিকট আসলেন এবং আমাকে দেখে চিনতে পারলেন। তিনি আমাকে পর্দার বিধানের পূর্বে দেখেছিলেন। তিনি আমাকে চিনতে পেরে ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়লে আমি জাগ্রত হই। আমি (তাকে দেখে) আমার চাদর দ্বারা মুখমন্ডল আবৃত করলাম। অন্য বর্ণনায় আছে, পর্দা করলাম (দীর্ঘ হাদীছের অংশ)।[বুখারী হা/৪৭৫০; মুসলিম হা/২৭৭০; ইবনে সাদ ১৮/৬২-৬৬, আহমাদ ৬/১৯৪-১৯৭]

আলোচ্য হাদীছগুলি প্রমাণ বহন করে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় মহিলা ছাহাবীগণ চেহারা ঢেকে পর্দা করতেন।]



মহিলাকে কতটুকু ঢেকে রাখতে হবে ঘরে এবং ঘরের বাহিরে?



একজন মহিলাকে কতটুকু ঢেকে রাখতে হবে ঘরে এবং ঘরের বাহিরে? মাহরাম এবং গায়ের মাহরামের সামনে? যারা নিকট আত্মীয় কিন্তু গায়ের মাহরাম তাদের সামনে? বোরখা পরে ভিতরে পাতলা কাপড় পরলে পর্দা হবে কিনা?

সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্‌র।

অনেকেই ধারনা করে যে নারীদের পর্দা হলো যখন তারা বাড়ী থেকে বের হবে তখন তারা অপরিচিত ব্যক্তিদের থেকে পর্দা করবে, পক্ষান্তরে পরিচিত ও আত্মীয় স্বজন বলতে যা বুঝায় তাদের কারো থেকে পর্দা করার প্রয়োজন নেই এবং তারা এ ধারনাও পোষণ করে থাকে যে, নারীদের চাচা শ্বশুর, মামা শ্বশুর, খালু শ্বশুর, ভাশুর (স্বামীর বড় ভাই) দের সাথে কি কোন খারাপ ধারনার অবকাশ রয়েছে বা তাদের ক্ষেত্রে কি কোন ফিতনার আশঙ্কা রয়েছে যে, তাদের থেকে পর্দা করতে হবে? হ্যাঁ অবশ্যই পর্দা করতে হবে।

যাদের সামনে মহিলারা মুখ দেখাতে পারবে:

স্বামী, বাবা (দাদা-নানা), শ্বশুর (দাদা শ্বশুর-নানা শ্বশুর), পুত্র (নাতি), স্বামীর পুত্র (নাতি), ভাই ( আপন ও সৎভাই), ভাতিজা (ভাইয়ের ছেলে), ভাগ্নে (বনের ছেলে), নাবালক ছেলে যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ।

এই ব্যক্তিদের সামনে কতটুকু শোভা প্রকাশ করা যাবে?

এই ব্যক্তিদের সামনে যেসব পোশাক পরে মেয়েরা যেতে পারবে তা হচ্ছে। গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢিলা-ঢালা কাপড় (মেক্সি) পড়বে। ওড়না পড়বে যা মাথা থেকে বক্ষদেশ পর্যন্ত ঢেকে রাখবে। মুখ, হাত, পা খোলা রাখা বৈধ।    

উপরের উল্লেক্ষিত ব্যক্তি ছাড়া সবার সামনে পর্দা করতে হবে, তা ঘরে হোক বা বাহিরে হোক। আমাদের দেশে মনে করা হয়, স্বামীর ভাইদের সামনে বা স্বামীর আত্মীয়দের সামনে বা নিজ আত্মীয়দের সামনে মুখ খোলা জায়েয। কিন্তু তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং ইসলাম বহির্ভূত কাজ।

অন্যদের সম্মুখে কিরূপ পর্দা করতে হবে?

অন্যদের সম্মুখে ঢিলা-ঢালা বোরখা পড়তে হবে, টাইট ফিটিং বোরখা যাতে শরীরের গঠন প্রকাশ পায় তা পড়া যাবে না। হাত, পা এমন কি চোখও ঢেকে রাখতে হবে। কোন ডিজাইন করা বোরখা পড়া যাবে না, যেমন নকশা করা বা গাছ-পালা, ফুল-ফল ইত্যাদি দাগানো। কালো ব্যতীত অন্য কোন সুন্দর রঙের বোরখা পড়া যাবে না।

বোরখা পরে ভিতরে পাতলা কাপড় পরলে পর্দা হবে কিনা?

হ্যাঁ হবে, তাতে কোন সমস্যা নেই। যথা সম্ভব আল্লাহ্‌কে ভয় করে পর্দা করতে হবে।

আল্লাহ্‌ যেন মুসলিম নারী জাতিকে পর্দার সাথে চলার তৌফিক দান করেন।





No comments:

Post a Comment

Thank you very much.