* * শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ের অবিস্মরণীয় এবং প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি আবার মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তিকালীন সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সকল রাজনৈতিক দলনিষিদ্ধ করে একটি মাত্র দল বাকশাল গঠন করেন এবং সেই দলটির আজীবন সভাপতি হয়ে যান। চারটি মাত্র পত্রিকা রেখে বাকি সকল পত্রিকা নিষিদ্ধ করেন। তার সময়ে রক্ষী বাহিনী এবং মুজিব বাহিনীর হাতে অসংখ্য মানুষের হত্যা এবং নির্যাতনের প্রমাণ আছে। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময়ে যখন অনেক মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছিল সেই সময়ে তার দুই ছেলের মাথায় সোনার মুকুট দিয়ে বিয়ে অনুষ্টিত হয়। তার একটি ছবি পরদিন ইত্তেফাক ছাপিয়েছিল ।
*** জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছিলেন ( যার On behalf এ হোক দেশবাসী তার গলাতেই ঘোষনাটি শুনেছিলেন, যার ভয়েস রেকর্ডটি এখনো পাওয়া যাচ্ছে) মুক্তির যুদ্ধে সেক্টর কম্যান্ডার ছিলেন এবং জেড ফোর্সের প্রধান ছিলেন। সেই তিনিই আবার শাসক থাকাকালীন বহুদলীয় রাজনীতির অবাধ সুযোগ প্রতিষ্ঠা করেন ।
* * কর্ণেল শরিফুল হক ডালিম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম অবদানের জন্য যুদ্ধের পর বীর উত্তম পুরস্কারে ভূষিত হন।
®বানোয়াট ও ইতিহাস বিকৃতির স্বাধীনতা ঘোষণাঃ
► ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর থেকে ২৬ মার্চ ভোরের কোনো এক সময়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার একটি ঘোষণাপত্র লিখেছিলেন। ( মিথ্যার একটা পর্যায় থাকে কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখানে ইতিহাসের চরম বিকৃতি ঘটানো হয়েছে । একজন ব্যক্তি স্বাধীনতা ঘোষণা পত্র লিখবেন আর তা কোন সময় লিখা হয়েছে তার উল্লেখ এবং সাক্ষী কিছুই থাকবে না এটা কি কোন বিবেকবান মানুষ মেনে নেবে ? )
► ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণাপত্রটি সম্প্রচার করা হয়। তবে খুব কম মানুষই সম্প্রচারিত ঘোষণাটি শুনতে পেয়েছিল । ( বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা পত্র পাঠ করা হবে কিন্তু কেউ শুনবে না এটা কেমন গাঁজাখুরি টাইপের ইতিহাস বিকৃতি ? অথবা কোনা প্রমাণ থাকবে না এটাও একটা মিথ্যার বেসাতি । )
©সঠিক এবং সত্যিকার স্বাধীনতা ঘোষণাঃ™
► ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কালুরঘাট থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে একটি ঘোষণা পাঠ করেন। ওই ঘোষণা বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো শুনতে পেয়েছিল এবং বিশ্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারে জানতে পারে।
⇒বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ তৃতীয়, নবম ও দশম খণ্ড ।
** বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১১ এপ্রিল জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বেতার ভাষণে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। নৌ, স্থল ও বিমানবাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলার ভাই-বোনেরা যে সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধের জন্য চট্টগ্রাম আজও শত্রুর কবলমুক্ত রয়েছে।’ তাজউদ্দীন আহমদ নিশ্চয়ই দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেননি এবং জিয়াউর রহমানের অযথা প্রশংসা করার মতো তাঁর কাছে এ ছাড়া অন্য কোনো কারণ ছিল না। বর্তমানের একজন প্রতিমন্ত্রী কর্তৃক জিয়াকে পাকিস্তানের চর হিসেবে আখ্যায়িত করা আর তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্য, কোনটি সঠিক ? তাজউদ্দিন আহমদ কি অসত্য ভাষণ করেছিলেন?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনীর আগ্রাসনকে ঠেকানোর জন্য সোভিয়েত বাহিনী ১৯৪২ সালের ১৭ থেকে ১৮ নভেম্বর ভলগোগ্রাড শহরে এক অসম সাহসিকতায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এরপর ১৯ নভেম্বর সোভিয়েত নেতা মার্শাল স্টালিনের নেতৃত্বে মার্শাল জুকভ যে আক্রমণ পরিচালনা করেন, তার পরিণতিতে জার্মান বাহিনী ৮ লাখ ৫০ হাজার সৈন্য হারিয়ে ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণ করে। সোভিয়েত পক্ষে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫০ হাজার সৈন্য। এই যুদ্ধে বিজয়ের জন্য স্টালিনের রণনীতি ও রণকৌশলের সফল প্রয়োগকে কৃতিত্ব দেওয়া হয় এবং পরিণতিতে ভলগোগ্রাডের নামকরণ করা হয় স্টালিনগ্রাড। তাজউদ্দীন আহমদ এসব ইতিহাস জানতেন বলে তুলনা করার গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করতে এবং বুঝতে পারতেন।
যুদ্ধ শুরু করার দিনগুলোতে কে, কীভাবে ঘোষণা করেছেন সে সম্পর্কেও প্রচুর বিতর্ক হচ্ছে। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ কলকাতা থেকে প্রকাশিত যুগান্তর মন্তব্য করেছে, ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধান মেজর জিয়া আজ ঘোষণা করেন যে পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ স্থান এখন তাঁর মুক্তি ফৌজের দখলে রয়েছে। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো তথা বিশ্ববাসীকে তা দেখে যাওয়ার জন্য তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।’ ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল কলকাতার আনন্দবাজার লিখেছে, ‘বাংলাদেশের তিন সেনাপতি : বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকা ও শহর ছাড়া প্রায় সবটাই এখন মুক্তি ফৌজের দখলে। এই প্রশাসনে তিনটি সেক্টরের নেতৃত্ব করছেন তিনজন সেনাপতি। তারাই মিলিতভাবে মুক্তি ফৌজের নিয়ন্ত্রণ করছেন। আওয়ামী লীগের অনুগত সামরিক অফিসার ও কর্মচারীরা তাদের সঙ্গে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করছেন। এই তিন সেনাপতিরা হলেন মেজর খালেদ মুশাররফ (শ্রীহট্ট সেক্টর), মেজর সফিউল্লা (ময়মনসিংহ) ও মেজর জিয়াউর রহমান (চট্টগ্রাম)। জিয়াউরই মেজর জিয়া নামে অস্থায়ী সরকারের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেছিলেন।’
কিন্তু ঘোষণাটা কেমন করে হয়েছিল? স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইপিআরে কর্মরত মো. আশরাফ আলী সরদার বলেছেন, ঢাকায় অবস্থিত সিগনালের প্রধান বেতার কেন্দ্র রাত ১২টার সময় বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়ার আগে বাংলাদেশের সব ইপিআর বেতার কেন্দ্রে খবর পৌঁছে দেয়া হয় যে, উইং কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রহমান আওয়ান ‘আমাদের নির্দেশ দিচ্ছে সব বেতার যোগাযোগ বন্ধ রাখার জন্য।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘২৬ মার্চ সকাল ১০টা পর্যন্ত আমাদের এইচএফ চালু থাকে, যার মাধ্যমে ২৫ মার্চের ঘটনা নায়েক শহীদ বাশার বাইরের সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর শেষ সংবাদে চট্টগ্রামকে বলেছিলেন যে, আমাদের সবাই বন্দি হয়ে গেছে। হয়তো কিছুক্ষণ পর আমিও বন্দি হয়ে যাব এবং আর নির্দেশ দেয়ার সময় পাব ন। তোমরা সব পশ্চিমাদের খতম কর। চট্টগ্রাম থেকে হাবিলদার বাহার ওই সংবাদ সীমান্তের চৌকি পর্যন্ত পৌঁছে দেয় এবং আমাদের লোকজনকে অনুপ্রাণিত করার জন্য সে বলেছে, ‘আমি ঢাকা থেকে বলছি। সম্পূর্ণ ঢাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে এসেছে এবং ইপিআরের ডিরেক্টর জেনারেল ব্রিগেডিয়ার নেসার আহমদ বন্দি হয়েছেন। তোমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড় এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের বন্দি করে আমাকে রিপোর্ট দাও।’ দেখা যাচ্ছে, এই বার্তার সঙ্গে অন্য কারও নাম যুক্ত নেই এবং ব্যক্তির আবেগেই বার্তার ভাষা পরিবর্তিত হয়েছে। ( এখানে ও আওয়ামীরা প্রচার করে এইভাবেই শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা করেন । আসলে মিথ্যা, চিরকালই মিথ্যা , কোন কাহিনিতেই মুজিব পুত্ররা স্থির থাকতে পারে না । যা দেখে , শুনে সবই শেখ মুজিবের কর্ম মনে করে এবং জনগনকে সেটাই জোর করে স্বীকার করাতে চায় । )
মেজর জিয়ার ঘোষণা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফরিদপুরের হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রম মাসিক গণমন পত্রিকায় ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে একটি সাক্ষাত্কার দেন। সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, ‘২৭ শে মার্চ রাত্রে সর্ব প্রথম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের (বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি) কণ্ঠস্বর ঘোষিত হলো, আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি।’
মার্চ মাসে বিশেষ করে ২৫ মার্চ ও তত্পরবর্তী সময়ে ঢাকা সেনানিবাস ও শহরে যা ঘটেছিল, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে ক্যাপ্টেন পদে ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত আবু তাহের সালাউদ্দীন বলেন, ‘ইতিপূর্বে সন্ধ্যা ৭টার সময় ক্যাপ্টেন এনামের কক্ষে রেডিওতে আমরা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়াউর রহমানের (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) ভাষণ শুনতে পাই। বেতারে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সব বাঙালি সেনাবাহিনীর সদস্য, ইপিআর, বিমান বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও জনসাধারণকে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের চিরতরে এ দেশ থেকে নির্মূল ও খতম করার আহ্বান জানান।’
বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে জিয়াউর রহমানের সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় : ‘এই বিরাট শক্তির মোকাবিলায় বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব হবে না—এ কথা বাঙালি সৈন্যরা বুঝেছিলেন। তাই শহর ছেড়ে যাওয়ার আগেই বিশ্ববাসীর কাছে কথা জানিয়ে যাওয়ার জন্য মেজর জিয়া ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান। বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা মেজর জিয়াকে পেয়ে উত্ফুল্ল হয়ে ওঠেন। কিন্তু কী বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আবার তা ছিঁড়ে ফেলেন। কী জানাবেন তিনি বিশ্ববাসী এবং দেশবাসীকে বেতার মারফত? এদিকে বেতারকর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিলেন—আর ১৫ মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়া ভাষণ দেবেন। কিন্তু ১৫ মিনিট পার হয়ে গেল। মেজর জিয়া মাত্র তিন লাইন লিখতে পেরেছেন। তখন তাঁর মানসিক অবস্থা বুঝার নয়। লেখার ঝুঁকিও ছিল অনেক। ভাবতে হচ্ছিল শব্দ চয়ন, বক্তব্য পেশ প্রভৃতি নিয়ে। প্রায় দেড় ঘণ্টা মুসাবিদার পর তিনি তৈরি করেন তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি। নিজেই সেটা তিনি বাংলা এবং ইংরেজিতে পাঠ করেন।’
অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জিয়াউর রহমান নিষ্ক্রিয় বসে ছিলেন না। পুরো যুদ্ধের সময়, প্রথম দিকে তিনি ছিলেন সেক্টর কমান্ডার ও পরবর্তী সময়ে জেড ফোর্সের কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম জেলা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার পুরো পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত সেক্টর ১-এর কমান্ডার ছিলেন জিয়াউর রহমান, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত। এরপর এ দায়িত্ব পান মেজর রফিকুল ইসলাম। খালেদ মোশাররফ এবং শফিউল্লাহ উভয়েই যুদ্ধের প্রথম কয়েক মাস সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে এরা কে ফোর্স এবং এস ফোর্সের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অথচ অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল হারুন ৯ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত মন্তব্যে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে জিয়াউর রহমান ছিলেন এরিয়া কমান্ডার। পরে তিনি ফোর্স কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কখনও সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না।’ সত্যের এক অদ্ভুত অপলাপ। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল হারুন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গেও জড়িত। তিনি কি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে ইতিহাস বিকৃতির দায়ে দায়ী করবেন, না তাদের ওয়েবসাইট সংশোধন করতে বলবেন? কেন তিনি এই সত্য অস্বীকার করলেন, তা স্পষ্ট নয়। ১৯৭২ সালের ৪ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত সাক্ষাত্কারে সব মুক্তিযোদ্ধার প্রধান জেনারেল ওসমানী বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে আমি ১১টি সেক্টরে ভাগ করেছিলাম। ১১টি সেক্টর একেকজন অধিনায়কের অধীনে ছিল এবং প্রত্যেক অধিনায়কের একটি সেক্টর হেড কোয়ার্টার ছিল। ... যখন বাংলাদেশ সরকার আমাকে সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ করেন, তখন আমি তাদের অনুমোদনক্রমে লে. কর্নেল (বর্তমানে মেজর জেনারেল) এম এ রবকে চিফ অব স্টাফ নিয়োগ করি। তিনি আমার পরে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন। তিনি গণপরিষদেরও সদস্য। বিভিন্ন সেক্টরের কমান্ডার নিয়োগ করি : এক নম্বর সেক্টরে প্রথম মেজর (বর্তমানে কর্নেল) জিয়াউর রহমান, পরে মেজর রফিক।’ জেনারেল ওসমানীর এই বক্তব্যের সমর্থন রয়েছে জেনারেল সফিউল্লাহর বক্তব্যে, যিনি ছিলেন তিন নং সেক্টরের কমান্ডার, এস ফোর্সের কমান্ডার এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সদস্য মেজর রফিকুল ইসলাম বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চান না। ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত কলকাতায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনের বরাত দিয়ে তিনি তার লেখা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে (১৯৮১) গ্রন্থে সভায় উপস্থিতদের যে নামের তালিকা দিয়েছেন, তাতে মেজর জিয়াউর রহমানের নাম আছে। কিন্তু পরের পৃষ্ঠায় বিভিন্ন জনের দায়িত্ব বণ্টনের যে তালিকা দিয়েছেন তাতে কোনো পদবি অনুযায়ীই জিয়াউর রহমানের নাম নেই।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সমশের মবীন চৌধুরীর স্মৃতিগাথা.............
১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ মাসে আমি মেজর জিয়ার অধঃস্তন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে চট্টগ্রামস্থ অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলাম। মার্চের ১ তারিখ থেকে ব্যাটালিয়নের ভারপ্রাপ্ত অ্যাডজুডেন্টের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছিল। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ১১ জন সেনা কর্মকর্তার মধ্যে আমরা সাতজন ছিলাম বাঙালি। আর ৩০০ সৈনিকের মধ্যে সকলেই ছিল বাঙালি। ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন পাঞ্জাবি লেঃ কর্নেল আব্দুর রশীদ জেনজুয়া। আর মেজর জিয়া ছিলেন সহ-অধিনায়ক।সেই ২৫ মার্চের কালো রাতে মধ্য রাতের পরপরই পাকিস্তান সামরিক বাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চট্টগ্রামে তারা প্রথম আক্রমণ চালায় সেনানিবাসের ভেতরে। যেখানে বেলুচ রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টারে লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীসহ প্রশিক্ষণাধীন শত শত বাঙালি সৈনিককে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেই আক্রমণের খবর মেজর জিয়ার কাছে পৌঁছানো হয়। তাত্ক্ষণিকভাবেই উনি গর্জে উঠেন। বললেন, ‘উই রিভোল্ট’ (আমরা বিদ্রোহ করলাম)। মেজর জিয়ার সেই বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করে করা হয়নি। বাস্তবতার প্রেক্ষিতে তিনি এই ঐতিহাসিক এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের তাত্পর্যতম সিদ্ধান্ত নিজেই নেন। বিদ্রোহ ঘোষণা করার পরপরই অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের একস্থানে জড়ো করা হয় এবং একটি পানির ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে মেজর জিয়াউর রহমান আমাদের উদ্দেশে ঘোষণা দেন, উনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। বলেন, ‘এখন থেকে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ।’ উপস্থিত অফিসার ও সৈনিকদের সমর্থন চাইলে একবাক্যে আমরা সবাই একাত্মতা প্রকাশ করি। উনি আরও বলেন, স্বাধীনতা ঘোষণা শুধু নয়, এখন এই স্বাধীনতার জন্য আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হবে। আমরা সবাই আমাদের প্রস্তুতির কথা ওনাকে জানাই। শুরু হয় বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। পূর্ববাংলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বাধিকার আন্দোলন মুহূর্তের মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমানের বিদ্রোহ ঘোষণার মাধ্যমে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়।
মেজর জিয়া সৈনিকদের উদ্দেশে আবার বক্তব্য রাখেন এবং বিদ্যমান ভয়াবহ পরিস্থিতির একটি চিত্র অংকন করেন। তার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সবাইকে দিয়ে শপথ পাঠ করান যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমরা যুদ্ধ করব এবং প্রয়োজনে আত্মবিসর্জন দেব। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটাই ছিল, সবচেয়ে প্রথম এবং উল্লেখযোগ্য শপথপাঠ।
কালুরঘাট ট্রান্সমিশন সেন্টার, যেটাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে নামকরণ করা হয়, মেজর জিয়া ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা সেখান থেকেই দেন। সেই ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘আমি মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম।’ এই ঘোষণায় তিনি বাংলাদেশ ও বাইরের সব বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে তিনি বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক ও শান্তিকামী রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য আহ্বান জানান। সর্বশেষে উনি নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে ঘোষণা দেন। এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা।
বন্দি অবস্থায় চরম শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার আমার ওপর চালানো হয়, যদিও গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে আমি শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল ছিলাম। বন্দি অবস্থায় আমাকে কোনো চিকিত্সা দেয়া হয়নি। আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতাসহ ছয়টি অভিযোগ এনে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। যে ছয়টি অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল, তার সবক’টিতে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে, এ বিষয়ে সবাই নিশ্চিত ছিল। আল্লাহর রহমতে সেই বিচার প্রক্রিয়া পাকিস্তান সরকার শেষ করতে পারেনি। কারণ ১৬ ডিসেম্বরে তারা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। দীর্ঘ আট মাস আট দিন বন্দি থাকার পর ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর মুক্ত বাংলাদেশের মুক্ত আকাশ আমি দেখতে পাই।
No comments:
Post a Comment
Thank you very much.