জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এ শুধু একটি সিরিজ জয় নয়, নিজেদের ফিরে পাওয়াও। টেস্ট র্যা ঙ্কিংয়ের নবম-দশমের লড়াইয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য যে রকম আত্মবিশ্বাসী নৈপুণ্য ফুটিয়ে তোলা দরকার, ঢাকার পর খুলনা টেস্টেও তা দেখল সবাই। খেলোয়াড় থেকে শুরু করে কোচ-কর্মকর্তা হয়ে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী, সবাইকেই ছঁুয়ে গেল আবেগ। আবহ সংগীত হয়ে যেন বেজে গেল, ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে...।’
বিস্ময়কর হলেও সত্যি, এই ‘আনন্দধারা’ সবচেয়ে কম ‘বহিছে’ সেই খেলোয়াড়দের মধ্যেই, যাঁরা আনন্দটাকে সংক্রামক রোগের মতো ছড়িয়ে দিয়েছেন সবার ভেতর। এটা ঠিক যে ম্যাচ জয়ের পর ড্রেসিংরুমে ‘আমরা করব জয়...’ গানটা কাল একটু বেশিই জোরে গেয়েছেন খেলোয়াড়েরা। কিন্তু ওই পর্যন্তই। মাঠে যখন দর্শকের অভিনন্দনের জবাব দিতে যাচ্ছিলেন সবাই, তখনই মনে পড়ল—আরও তো একটা টেস্ট বাকি! তাহলে এখনই সব উদ্যাপন করে ফেলা কেন? পুরো মাঠ দৌড়ে ‘ল্যাপ অব অনার’ দেওয়ার চিন্তা বাদ পড়ে গেল তখনই। খেলোয়াড়েরা হেঁটে গেলেন শুধু ড্রেসিংরুমের দুই প্রান্তের দর্শকদের দিকে। হাততালির জবাব দিলেন দুই হাত তুলে।
এ সময় ‘কাবাবে হাড্ডি’র মতো দৃষ্টিকটু লেগেছে ওয়াকিটকি হাতে বিসিবির নিরাপত্তাকর্মীদের বাড়াবাড়ি। যেভাবে চারদিক ঘিরে রেখে খেলোয়াড়দের আনন্দ প্রকাশকে শৃঙ্খলবদ্ধ করে রাখলেন তাঁরা, মনে হলো দেশে বুঝি যুদ্ধ-পরিস্থিতি চলছে! ক্রিকেটাররা গ্যালারির কাছে গেলেই কেউ বোমা মেরে দেবে! অথবা সেটা খেলোয়াড়দের আশপাশে থেকে ক্যামেরার ফ্রেমে ঢোকার ‘অপচেষ্টা’ও হতে পারে। সে যাই হোক, তাঁদের অকারণ ধাক্কাধাক্বি যে খেলোয়াড়েরাও পছন্দ করেননি, সেটা অতি উৎসাহী নিরাপত্তাকর্মীদের একজনকে কড়া ধমক মেরে ভালোই বুঝিয়ে দিয়েছেন সাকিব আল হাসান।
খেলোয়াড়দের মতো কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের আনন্দের প্রকাশও ছিল নিয়ন্ত্রিত। নির্বাচকদের সঙ্গে অভিনন্দন বিনিময় করে ড্রেসিংরুমের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে ‘খুব খুশি নিশ্চয়ই...’ মন্তব্যের জবাবে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি আনন্দিত।’ শুধু এটুকুই! এবার একটা লাইন বাড়তি যোগ করলেন কোচ, ‘আমি আরও বেশি খুশি হব যখন আমরা বিশ্বকাপেও কিছু ম্যাচ জিতব।’
হিথ স্ট্রিকের জন্য দিনটা ছিল অন্যরকম। তিনি বাংলাদেশ দলের পেস বোলিং কোচ হলেও জিম্বাবুয়ের মানুষ। একদিকে পেশাদারি, অন্যদিকে জাতীয়তাবোধ। স্ট্রিক এগিয়ে রাখবেন কোনটাকে? প্রশ্নটা করতেই হাসতে হাসতে আগে বাংলায় বললেন, ‘খুব ভালো লাগছে।’ এরপর একটু সিরিয়াস, ‘ওদের (জিম্বাবুয়ে) জন্য খারাপ লাগছে, তবে বাংলাদেশ সিরিজ জেতায় আমি খুশি। আর এই উইকেটে শুধু জিম্বাবুয়ে কেন, বিশ্বের যেকোনো দলই বাংলাদেশের স্পিনারদের সামনে সংগ্রাম করবে।’ সিরিজের প্রথম দুটি টেস্ট দেখে প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদের পর্যবেক্ষণ, ‘সবচেয়ে ভালো দিক, ওরা আবারও সত্যিকারের একটা দল হয়ে উঠছে।’ ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের কথায়ও সেই প্রতিধ্বনি, ‘একটা সময়ে মনে হয়েছে টেস্টটা ড্র হবে, আমরা ব্যাকফুটে ছিলাম। কিন্তু আমরা যে পাঁচ দিনই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ টেস্ট ক্রিকেট খেলতে পারি, সেটা এখন দল হিসেবে বিশ্বাস করা যায়।’
সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখায় বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সাকিব আল হাসান। খুলনা টেস্টে তা আবারও প্রমাণিত। সেঞ্চুরি আর দুই ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়ে সাকিব শুধু ম্যান অব দ্য ম্যাচই হননি, ঢুকে গেছেন ইতিহাসের পাতায়। ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে পাশে বসিয়েই সাকিব-স্তুতিতে মাতলেন মুশফিক, ‘বিশ্ব ক্রিকেটেই সাকিবের মতো খেলোয়াড় খুব কম আছে। দলের জন্য তার অবদান সব সময়ই থাকে। ওর মতো একজন খেলোয়াড় থাকলে যেকোনো অধিনায়কই নির্ভার থাকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে তাকে মিস করেছি। কিছু ম্যাচ ছিল, ও থাকলে সেগুলো হয়তো জিততে পারতাম।’
যা গেছে, গেছে। যা আছে, তা নিয়ে বেঁচে থাকাতেই আনন্দ। তবে সে আনন্দটা নিয়ন্ত্রণে রেখে বাংলাদেশ দল এখন পাখির চোখ করছে চট্টগ্রাম টেস্টে জয়ের দিকে। খুলনা টেস্টের জয় তারা উৎসর্গ করেছে খুলনারই ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় জাতীয় দলের অকালপ্রয়াত ক্রিকেটার মানজারুল ইসলামকে। তবে চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করা গেলেই বোধ হয় বেশি তৃপ্ত হবে মানজারুলের আত্মা, আনন্দে আরও আত্মহারা হবে দেশের কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমীও।


No comments:
Post a Comment
Thank you very much.