বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি ঝোঁক আলফ্রেড তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলন। প্রথমদিকে বিভিন্ন ব্যাবসার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হতদরিদ্র অবস্থায় থাকলেও একসময় ইমানুয়েল নোবেল ধীরে ধীরে স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে শুরু করেন। এসময় তিনি কিছু নতুন ধরণের ম্যাটেরিয়াল, যেমন প্লাইউড, এবং বিস্ফোরক বানাতে সক্ষম হন। রসায়ন ও বিজ্ঞান নিয়ে প্রচন্ড উৎসাহী তার মেধাবী ছেলে আলফ্রেড তার পড়ালেখা খুব ভালোভাবে শেষ করে একসময় পারিবারিক অস্ত্রনির্মাণ কারখানায় কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিনি নতুন ধরণের অস্ত্রশস্ত্র, বিস্ফোরক ও যুদ্ধ উপকরণ উদ্ভাবন করাতে অদ্বিতীয় হয়ে উঠেন।
মালালা ইউসুফজাইকে বলা হয়ে থাকে তথাকথিত ইসলামি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ওয়ার অন টেরর লড়তে থাকা তেলসম্পদলোভী পাশ্চাত্য দখলদার যুদ্ধবাহিনীর পোষ্টার গার্ল। এবং কৈলাশ সত্যার্থী সম্পর্কে অভিযোগ আছে শিশুশ্রম বন্ধের আন্দোলনের নামে ভারতের স্থানীয় কার্পেট প্রস্তুতকারক শিল্পের ক্ষতি করার।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি এ সময়টাতে আমেরিকায় চলছিলো সিভিল ওয়ার। উঠতি পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্যান্য দেশেও অস্ত্রের চাহিদা বাড়ছিলো। নিজের মেধা ও যোগ্যতা খাটিয়ে বিভিন্ন ধরণের যুদ্ধ উপকরণ তৈরি করে আলফ্রেড হয়ে উঠেন সেসময়ের অন্যতম ধনী ও সফল যুদ্ধাস্ত্র আবিস্কারক। আমরা সাধারণত আলফ্রেড নোবেলকে চিনি মারাত্মক বিস্ফোরক, যা এখন পর্যন্ত ভয়াবহতার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি কার্যকর, ডায়নামাইটের আবিস্কারক হিসেবে। তবে ডায়নামাইট যে কেবল ধ্বংসের জন্যই ব্যবহার হয় তা নয়। অনেক সময় বিভিন্ন খনিতে এবং দুর্গম জায়গায় রাস্তা বানানোর মতো কাজেও ডায়নামাইট অপরিহার্য একটি বিস্ফোরক। শেষদিকে তেলখনিতে বিনিয়োগ করে এবং প্রায় সাড়ে তিনশ’র মতো আবিস্কারের প্যাটেন্টের মাধ্যমে আলফ্রেড ও তার ভাই লুডভিগ সেসময়কার অন্যতম ধনাঢ্য পরিবারে পরিণত হন।
আলফ্রেডের বড়ভাই লুডভিগ নোবেল মারা যান ১৮৮৮ সালে। তখন প্যারিসের এক পত্রিকা ভুলবশত আলফ্রেড মারা গিয়েছেন ভেবে তার সম্পর্কে একটা ফিচার প্রকাশ করে। শিরোনাম ছিলো, “মৃত্যুর সওদাগর আজ নিজেই মৃত”। লেখাটি পড়বার পর আলফ্রেড তার নিজের আবিস্কারগুলো এবং পুরো পৃথিবীজুড়ে এসবের ব্যবহার নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৮৯৫ সালে মৃত্যুর আগে উইল করে যান, যেন তাঁর সম্পত্তি দিয়ে ‘মানবতাকে সর্বোচ্চ সেবা দেয়া’ মানুষদেরকে সম্মাননা দেয়া হয়। হয়ত নিজের প্রতি একধরনের দায়বদ্ধতা।
গত একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুইডেন এবং নরওয়ে থেকে যৌথভাবে দেয়া এই নোবেল পুরস্কার বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক এবং মূল্যবান সম্মাননায় পরিণত হয়েছে। সম্মানের সাথে সাথে অর্থের পরিমাণটাও নেহাতই কম নয় কিন্তু। বর্তমানে একজন নোবেল বিজয়ীকে দামী স্বর্ণের মেডাল ও সার্টিফিকেটের সাথে সাথে দশ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার দেয়া হয়। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় এগারো কোটি টাকার কাছাকাছি। যখন যৌথভাবে দু’জনকে এ পুরস্কার দেয়া হয়, যেমন এবছর শান্তিতে মালালা ইউসুফজাই এবং কৈলাশ সত্যার্থীপেয়েছেন,তাদেরকে এই টাকার অংকটা সমান দুই ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়।
পুরস্কার দেয়া হয় পাঁচটি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য। ফিজিক্স, কেমিষ্ট্রি, মেডিসিন, লিটারেচার এবং পিস। শান্তিতে অবদানের জন্য নোবেল দেয়ার ডকুমেন্টেড শর্ত হলো, পুরস্কার তাকেই দেয়া হবে, যে বা যারা “বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাঝে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক গঠনে, স্থায়ী সেনাবাহিনীর ক্ষতির মাত্রা ধ্বংস কিংবা হ্রাস করাতে এবং সংঘাত বন্ধ করে শান্তিচুক্তি ও সন্ধি সংঘটনে বিশেষ অবদান” রাখতে পেরেছে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, নোবেল পুরস্কারের যে পাঁচটি সেক্টর, এর মধ্যে শান্তি পুরস্কারটি প্রায়সময়ই বিতর্কিত একটি সেক্টর হিসেবে পরিচিত হয়ে এসেছে।
মানুষের সমাজে সম্মাননা কিংবা উপাধি সবসময় মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হিসেবে বিবেচিত। একসময় নাইটহুড দেয়া হতো প্রকৃত বীরদেরকে। পরবর্তীতে তা হয়ে গেলো ধনাঢ্য মানুষদের কিনে নেয়া উপাধি কিংবা রাজনীতিতে সুবিধার জন্য ব্যবহৃত উপাদান। নোবেল পুরস্কারেও ব্যাতিক্রম হলোনা। আমেরিকা-ভিয়েতনাম যুদ্ধের মূল কারিগর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়াটা ছিলো অন্যতম বিতর্কিত একটি ঘটনা। যে সময় ভিয়েতনামে নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনী মানুষ মেরে চলছিলো, তখন কিসিঞ্জারকে এ পুরস্কার দেয়াটা ছিলো চরম হাস্যকর একটা ব্যাপার। কিন্তু পুরো দুনিয়া জুড়ে নিজেদের মিডিয়া প্রোপাগান্ডা চালানোর জন্য পাশ্চাত্য সভ্যতা এধরণের কাজ করে এসেছে বরাবর এবং প্রচারণার শক্তি দিয়ে তা প্রতিষ্ঠাও করে ছেড়েছে।
উনিশশত চুরানব্বই সালে শান্তিতে নোবেল দেয়া হয় যৌথভাবে ইয়াসির আরাফাত, শিমন পেরেজ এবং আইজাক রবিনকে। আজ এই বিশ বছর পরও গাজা উপত্যকায় নির্মমভাবে নারী-শিশু-সাধারণ মানুষদের হত্যার ঘটনাগুলো সেই নোবেল শান্তিপদককে উপহাস করে চলছে। দুইহাজার নয় সালে দেয়া হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে। যার হাতে লেগে আছে আফগানিস্তান আর ইরাকের লাখো নিরপরাধ সাধারণ মানুষের রক্ত। আর এবছর যৌথভাবে শান্তিতে এই পুরষ্কারটি দেয়া হলো তালিবানদের হামলার শিকার আফগান মেয়ে মালালা ইউসুফজাই এবং ভারতীয় শিশু অধিকার আন্দোলন কর্মী কৈলাশ সত্যার্থীকে।
এ নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্নরকম আলোচনা পর্যালোচনা করা যায়। সবকিছুর আগে যে মৌলিক প্রশ্ন আমি রাখতে চাই, নোবেল শান্তি পদকের উদ্দেশ্য হিসেবে যা বিবৃত আছে, তা অনুযায়ী এই দুজন মানুষ কি ঐ পদক পাওয়ার দাবীদার? দুজনের একজনও কি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাঝে সংঘাত বন্ধে অবদান রেখেছে? অথবা যুদ্ধরত কোন স্থায়ী সেনাবাহিনীকে বিরত করতে ভূমিকা রেখেছে? অথবা কোন ধরণের শান্তিচুক্তি সম্পন্ন করিয়েছে কোথাও?
বরং মালালা ইউসুফজাইকে বলা হয়ে থাকে তথাকথিত ইসলামি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ওয়ার অন টেরর লড়তে থাকা তেলসম্পদলোভী পাশ্চাত্য দখলদার যুদ্ধবাহিনীর পোষ্টার গার্ল। এবং কৈলাশ সত্যার্থীর সম্পর্কে অভিযোগ আছে শিশুশ্রম বন্ধের আন্দোলনের নামে ভারতের স্থানীয় কার্পেট প্রস্তুতকারক শিল্পের ক্ষতি করার। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মতে, নিজস্ব শিল্পের ক্ষতি করে বিদেশী কর্পোরেট স্বার্থের সুবিধা করে দেয়ার জন্য কৈলাশ দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। এ অভিযোগকে কি পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায়? আমরা কি বাংলাদেশে দেখছি না গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকদের সমস্যাকে পুঁজি করে কিভাবে দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করে দিয়ে ভারতের হাতে সব তুলে দেয়া হচ্ছে?
সবমিলে আজ আমার শুধু বেচারা আলফ্রেড নোবেলের জন্য করুণা হয়। ভদ্রলোক তার জীবন সায়াহ্নে এসে অনুতপ্ত হয়েছিলেন। নিজের বিপুল ধনসম্পদ একটা ভালো উদ্দেশ্যে দান করে গিয়েছিলেন। আজ তিনি বেঁচে থাকলে নিঃসন্দেহে এইসব নোবেল কমিটির লোকজন এবং আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়ে যাওয়া নিও-ইম্পেরিয়ালিষ্ট আন্তর্জাতিক রাজনীবিদদেরকে লাঠিপেটা করতে যেতেন।
ইলোরা জামান: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী
No comments:
Post a Comment
Thank you very much.