যেমন ধরুন এখনকার ফুটবল নিয়ে আমাকে প্রথমেই বলতে হবে, আগের মতো ঝলক দেখানো খেলোয়াড় নেই। হ্যাঁ, মানছি আধুনিক ফুটবল টিমগেম। তারপরও দর্শক টানতে ব্যক্তিগত নৈপুণ্য খুবই প্রয়োজন। যেটি নব্বইয়ের শেষ দিক থেকেই হারাতে শুরু করে।
সালাউদ্দিন ভাই এই একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ান। তাঁর হাতে তো স্টার বানানোর মেশিন নেই! নিজের যে কাজ, বাফুফের সেই সাংগঠনিক কার্যক্রমে সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। ফেডারেশন পরিচালনায় মানুষটার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, তবু বাফুফে সভাপতির চেয়ারে বছর সাতেক কাটিয়ে ফুটবল-কর্মকাণ্ড অনেক বাড়িয়েছেন। কিন্তু প্রত্যাশার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছাতে তাঁর সামনে বড় বাধা তারকাহীনতা। সেই দেয়াল ভাঙতে বাফুফেতে ‘টিম ওয়ার্ক’ও দেখছি না, অথচ নির্বাচনের সময় কমিটিতে থাকতে ফুটবল প্রেম জাগে অনেকের। এঁদের বেশির ভাগই এখন ডুমুরের ফুল!
গত কিছুদিনে সবচেয়ে তৃপ্তির জায়গা প্রিমিয়ার লিগটা নিয়মিত হওয়া। এটি যদিও পুরোপুরিই ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে, তবু খেলার দাবিতে খেলোয়াড়দের আর আন্দোলন করতে হচ্ছে না, যা বলার মতোই অর্জন। নিচের দিকের সব লিগও নিয়মিত হয়েছে, মেয়েদের ফুটবলেও ভালোই অগ্রগতি। এমনকি হারিয়ে যাওয়া অনূর্ধ্ব-১৯ সোহরাওয়ার্দী কাপ ও শেরেবাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল এ বছর ফের চালু হবে শুনছি। এটাও ভালো উদ্যোগ।
খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক বেড়ে যাওয়াটাকেও উন্নতির তালিকায় রাখা যায়। ‘দামি’ খেলোয়াড়দের নিয়ে টিমগেম এখন বেড়েছে সত্য। তবে আবারও বলি, ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের কথা বললে আগের চেয়ে খেলার মান কমেছে।
খেলোয়াড়দের মধ্যে ভালো খেলার তাগিদও থাকা দরকার, যা আজকাল খুব একটা দেখি না। মৌসুমে দশ-বারোটি ম্যাচ বাকি থাকতেই এখনকার ফুটবলারদের অনেকে দল পাল্টায়। ক্লাবের প্রতি একটা নিবেদন ছিল আগে। তখন ছিল অপেশাদার যুগ। এখন পেশাদার যুগে খেলোয়াড়েরা বছর বছর দল পাল্টানোয় ক্লাব সংস্কৃতিই বিলুপ্ত! জাতীয় দলও এর ভুক্তভোগী। প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাবে এমিলিকে দশ বছর ধরে জাতীয় দলে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। অথচ পঁচাত্তর থেকে দশ বছর জাতীয় দলে খেলেছি ঘাড়ের ওপর অনেকের গরম নিশ্বাস নিয়ে।
পেশাদারি যুগে আছে আরও অনেক অসংগতি, যার অন্যতম ডিএফএ। জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ডিএফএ) গড়তে ফিফার এই ব্যবস্থাপত্রটা জন্মলগ্ন থেকেই বিকলাঙ্গ। বাংলাদেশ ইউরোপ নয় জেনেও ফিফার উচিত হয়নি এ দেশে ডিএফএ চাপিয়ে দেওয়া। ছয়-সাত বছরেও ডিএফএ ন্যূনতম অবকাঠামোহীন। জেলা ক্রীড়া সংস্থার অধীনে স্থানীয় ডিসি-এসপির সহায়তা পেত ফুটবল, মিলত সরকারি অনুদানও। এখন আর তা নেই।
সাধারণভাবে বললে ডিএফএগুলো ঠুঁটো জগন্নাথই। অনেক ডিএফএতে বসার ব্যবস্থাও নেই। আর্থিকভাবে কপর্দকশূন্য, যা দূর করতে ফেডারেশন দুই লাখ টাকা করে দিয়েছে গত বছর, তার আগে এক লাখ। দুর্দিনে সালাউদ্দিন ভাইয়ের এই কাজটাও প্রশংসনীয়। ফেডারেশনের বাইরে থেকেও গাঁটের পয়সা দিয়ে জেলার ফুটবল চাঙা করার চেষ্টা করছেন কাদের ভাই (শেখ জামালের সভাপতি মনজুর কাদের, যিনি বাফুফের ডিএফএ কমিটির প্রধানও)। এমন সংগঠকের বড়ই আকাল চলছে। তবে তিনি উদ্যোগ নিলেও ডিএফএ সেই জীর্ণই।
ডিএফএ হওয়ায় মাঠও এখন ঠিকভাবে পাওয়া যায় না। নারায়ণগঞ্জ ডিএফএর সভাপতি হিসেবে আমি এর ভুক্তভোগী। গত বছর নারায়ণগঞ্জ লিগের সময় রেখেছিলাম নভেম্বরে, কিন্তু ক্রিকেট থাকায় মাঠ পাইনি। সেই লিগ এখন চলছে। লিগটা করতে আমার ২৫ লাখ টাকা খরচ। ১২টা ক্লাবকে ১২ লাখ টাকার সঙ্গে জার্সি, ফুটবল দিয়েছি। আমি না হয় দৌড়ঝাঁপ করে স্পনসর পাই, অনেকেই তা পায় না। তাই অনেক জেলায় লিগ হয় নামকাওয়াস্তে। ৭ ম্যাচেই লিগ শেষ, আছে এমন অদ্ভুত নজিরও! বেশির ভাগ ডিএফএর শীর্ষ কর্তা নিষ্ক্রিয়।
ক্লাবগুলোর আর্থিক সংকট তীব্র হয়েছে আগের চেয়ে। আয়ের স্থায়ী পথ আগেও ছিল না, এখনো নয়। দুই-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে ক্লাব কাঠামোয় বদল আসেনি। এখনো জিম, মাঠ কিছুই নেই। বেশির ভাগ ক্লাবের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা সেকেলে। খেলোয়াড় তৈরির কার্যকর কোনো উদ্যোগও নেই।
তারপরও আমি আশাবাদী মানুষ। এখনো তাই স্বপ্ন দেখি—আবার ফিরে আসবে সত্তর-আশির সেই স্বর্ণযুগের ফুটবল!
অনুলিখন: মাসুদ আলম
এখনই যা করতে হবে
১ সারা দেশে ফুটবল চাঙা করা সবচেয়ে বড় কাজ। ডিএফএগুলোকে জাগিয়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৯ সোহরাওয়ার্দী কাপ ও শেরেবাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল মাঠে ফেরানো জরুরি।
২ খেলোয়াড়দের নিজেদের ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে। কারণ খেলোয়াড়দের ওপরই দেশের ফুটবলের অনেক কিছু নির্ভর করে। সুতরাং তাদের আত্মনিবেদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৩ ক্লাবগুলোর আরও পেশাদার হওয়া চাই। ঘরোয়া ফুটবল চাঙা করতে আবাহনী-মোহামেডানকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। এটা করতেই হবে।
৪ চলমান প্রিমিয়ার লিগসহ অন্য সব লিগ নিয়মিত হচ্ছে, এগুলো টানা চলতে থাকুক। তবে পেশাদার লিগটাকে ঢাকার বাক্সবন্দী না করে সারা দেশে ছড়ানো দরকার।
৫ ১৫-২০টি জেলাকে একটু বেশি আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। ওই জেলাগুলোতে নিয়মিত প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগ হতে হবে। এতে মানসম্মত ও বেশিসংখ্যক খেলোয়াড় উঠে আসবেই।

