বার্লিনের ম্যাচটা শেষ হয়েছে মাত্র। মাঠে বার্সেলোনা খেলোয়াড়দের উৎসব চলছে। সাদা-কালো জার্সির জুভেন্টাস খেলোয়াড়েরা বিমর্ষ মুখে সেই উৎসব দেখছেন। পেশাদারির মুখোশের আড়ালে আবেগ লুকিয়ে রেখে কেউ কেউ আবার অভিনন্দন জানাচ্ছেন প্রতিপক্ষকে। এর মাঝেই ক্যামেরা খুঁজে নিল উদাসী পিরলোকে। না, শ্মশ্রুগুম্ফের আড়ালে নির্লিপ্ত চেহারাটা আর নেই তখন। একপাশে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন তিনি! গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু জার্সি দিয়ে মুছছেন একটু পর পর, কিন্তু অশ্রুর জোয়ার থামছে না কিছুতেই!
তাঁর পক্ষে যেটুকু করার ছিল, করেছেন। তাঁর চেয়ে বেশি করেছেন দীর্ঘদিনের সতীর্থ জিয়ানলুইজি বুফন। চেষ্টার কমতি ছিল না কার্লোস তেভেজ, আলভারো মোরাতাদেরও। কিন্তু প্রতিপক্ষ দলটা যে বার্সেলোনা! এমন অবিশ্বাস্য আক্রমণভাগ, এমন দুর্দান্ত ফর্ম, আর এমন বোঝাপড়া নিজেদের মধ্যে যে তাদের সামনে এমনকি ‘প্রফেসর’ পিরলো আর সদা জাগ্রত বুফনরাও সাধারণ হয়ে যেতে পারেন যেকোনো দিন। সত্যটা জানতেন পিরলো, পরশু স্বচক্ষে সেটা ঘটতেও দেখলেন। জুভেন্টাসের হয়ে প্রায় ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে অন্তত একটা চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার সম্ভবত শেষ সুযোগ ছিল এটা তাঁর। খুব কাছে এসেও সেটি হাতছাড়া। কান্না তো আসবেই!
জুভেন্টাসের হয়ে না পারলেও এসি মিলানের হয়ে দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগে জেতার অভিজ্ঞতা তবু আছে পিরলোর। বুফনের সেটাও নেই। দুই দশকের ক্যারিয়ারে কত অর্জন, কত কীর্তি! চ্যাম্পিয়নস লিগটাই শুধু আক্ষেপ হয়ে থাকল কিংবদন্তি ইতালিয়ান গোলরক্ষকের কাছে।
জর্জো কিয়েলিনি না থাকায় মেসি-নেইমার-সুয়ারেজকে রোখা কঠিন হয়ে যেতে পারে জুভেন্টাসের জন্য—এটাই আগেই বলাবলি হচ্ছিল। কিয়েলিনি না থাকাতেই কি এই ব্যর্থতা! এই প্রশ্নটা হয়তো থেকে যাবে। কিন্তু কিয়েলিনি থাকলেও পতন ঠেকানো যেত কি না এই প্রশ্নও কি উঠবে না? চতুর্থ মিনিটেই ইভান রাকিটিচের গোলটা হলো বল বার্সেলোনার ১০ জন খেলোয়াড়ের পা ছুঁয়ে আসার পর! শেষে এসে নেইমার পাস দিলেন ইনিয়েস্তাকে। ইনিয়েস্তা থেকে রাকিটিচ। তাঁর শট সোজা জালে। রক্ষণব্যূহ সাজিয়ে যে বাজিমাত করা যাবে না, সেটা বুঝে কৌশল বদলাল সিরি ‘আ’র চ্যাম্পিয়নরা৷ পাল্টা-আক্রমণে বার্সেলোনার ডি-বক্সে আতঙ্কও ছড়াল তারা। তবে ক্ষণিকের জন্য৷ তেকাঠির নিচে বুফন অবিশ্বাস্য কয়েকটা সেভ না করলে ফাইনালের উত্তেজনায় কবেই যবনিকা পড়ে যায়! দানি আলভেজের শটটা কী দারুণভাবেই না ঠেকালেন!
অবশেষে ফুটবল-দেবতা জুভদের দিকে ফিরে তাকালেন ৫৫ মিনিটে। আলভারো মোরাতার গোলে উন্মাতাল বার্লিনের জুভ সমর্থকেরা। কিন্তু সেই উল্লাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দিলেন না লিওনেল মেসি নামের ফুটবল জাদুকর। ৬৮ মিনিটে প্রায় একক প্রচেষ্টায় গোলের সুযোগ তৈরি করলেন, শটও নিলেন। অভিজ্ঞ বুফন মেসির শট হাত লাগিয়ে ফেরালেও লুইস সুয়ারেজের ফিরতি শট আর ঠেকাতে পারলেন না।
২-১ ব্যবধান ৩-১ হয়ে যেতে পারত ৭১ মিনিটেই। কিন্তু ‘অনিচ্ছাকৃত’ হ্যান্ডবলে বাতিল হয়ে যায় নেইমারের গোল। শেষ পর্যন্ত বার্সেলোনার তৃতীয় গোলটা এল ওই নেইমারের পা থেকেই, পাঁচ মিনিট যোগ হওয়া সময়টা সপ্তম মিনিটে গড়ালে। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের শট জুভেন্টাসের জালে জড়াল, বাজল শেষ বাঁশিও!
গোল করেই বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং পেরিয়ে সমর্থকদের কাছে গিয়ে উৎসব শুরু করে দিলেন নেইমার। তার পর তো মাঠের মধ্যেই পঞ্চম চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের উৎসব বার্সেলোনার! ইউরোপিয়ান ফুটবল ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে দুবার ট্রেবল জেতার উৎসব! প্রথম মৌসুমেই ত্রিমুকুট জিতে কোচ লুইস এনরিকের স্মরণীয় শুরু, কিংবা শেষ মৌসুমে তিনটি ট্রফি জিতে জাভির স্মরণীয় বিদায়—বার্সেলোনার উৎসবের কত যে উপলক্ষ এদিন!

