google-site-verification: googlefee13efd94de5649.html ফটোগ্রাফীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস - তারুণ্যের কন্ঠস্বর

HeadLine

News Update :

Tuesday, September 15

ফটোগ্রাফীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ফটোগ্রাফীর পুরো কারিগরী ব্যপারটাকে খুব সহজ দুটো ধারনায় ভেঙ্গে ফেলা যায়। এক: যেকোন একটা দৃশ্য হতে যেই আলো আসছে, সেটাকে কোন ভাবে ধরে ফেলে একটা পর্দায় প্রতিফলিত করা। দুই: সেই প্রতিফলিত দৃশ্যকে স্থায়ীভাবে একটা মাধ্যমে ধারন করা।
প্রথম ব্যপারটি, তথা কোন একটা বিষয়বস্তুকে পর্দায় প্রতিফলিত করার বিষয়টি বহু আগে থেকেই জানা ছিল। একটি অন্ধকার চারকোনা বাক্সের সামনে তলে একটি সুইয়ের খোঁচার সমান ছিদ্র থাকলে এবং ঠিক বিপরীত দিককার তলে একটা সাদা পর্দা দেয়া হলে সেই পর্দায় উল্টোভাবে সামনের দৃশ্য ধরা পড়ে। ছিদ্রটার যায়গায় যদি একটা কাচের লেন্স বসিয়ে দেয়া যায়, তাহলে যে এই ছবি আরো স্পষ্ট হয়ে আসে, সেটা সেই ১৪০০ সালের দিকেই মানুষ জানতে পেরেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এই ছবিকে স্থায়ীভাবে ধরার প্রযুক্তি আবিস্কার করতে লেগে যায় ৪০০ বছরেরও বেশী।
Image-1-Pinhole-camera
ছবি ১: পিনহোল ক্যামেরা। credit: buzzle.com
১৮০০ সালের শুরুর দিকে আবিষ্কৃত হল যে কোন একটি প্লেটকে ‘আলোক সংবেদী (light sensetive)’ রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে কোটিং করে সেখানে ছবি প্রতিফলিত করলে ছবির বিভিন্ন অংশের আলোর তীব্রতার উপর নির্ভর করে ওই প্লেটের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন মাত্রায় বিক্রিয়া হয়। ফলশ্রুতিতে ছবিটা ফুটে ওঠে প্লেটের উপর। সমস্যা হল অন্য যায়গায়…এই ছবিকে স্থায়ী রুপ দেয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে ১৮০০ সালের গোড়ার দিকে লুই ডাগের (Louis Duguerre) এবং জোসেফ নিয়েপ (Joseph Niepce) এর যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরী হয় ‘ডাগেরোটাইপ (Duguerrotype)’ প্রসেস, যেখানে সিলভার হ্যালাইড নামের আলোক সংবেদী একটা যৌগের প্রলেপকে ব্যবহার করা হয় ছবি ধারনের মাধ্যম হিসেবে। তবে ছবি তোলার শখ হলে মিনিট পনেরো মাথা না নাড়িয়ে বসে থাকা লাগতো ক্যামেরার সামনে!
 ছবি ২: প্রথম ডগেরোটাইপ ছবি। সূত্র: উইকিপেডিয়া।
তিন নম্বর ছবিটি দেখুন। এটিও লুই ডাগের এর তোলা প্যারিসের একটি রাস্তার ছবি। আনুমানিক দশ থেকে বারো মিনিট ধরে ক্যামেরাতে আলো ঢোকার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল এই ছবি তোলার জন্যে; আগেই বলেছি যে ডাগেরোটাইপে একটা ছবি ধারন করতে দীর্ঘ সময় লাগতো, কেননা মাধ্যমটি খুব একটা আলোক সংবেদী করা যায়নি তখনও। মজার ব্যপার হল, ছবিতে দুইজন মানুষের উপস্থিতি (খেয়াল করে দেখুন)| এত লম্বা সময় ধরে ছবি এক্সপোজ করলে সাধারনত ছবিতে চলমান কোন কিছু ধরা পড়েনা (এক্সপোজার নিয়ে সামনে লেকচার আসছে), কিন্তু এই দুইজনের একজন ছিল জুতা পালিশকারী, আর একজন তার কাস্টোমার। যে কারনে এরা মোটামুটি স্থির ছিল এক যায়গায়।
Boulevard_du_Temple_by_Daguerre
  ছবি ৩: আরেকটি ডগেরোটাইপ ছবি – প্যারিসের রাস্তা । সূত্র: উইকিপেডিয়া।
যাই হোক। এই মুল প্রসেসগুলোতো আয়ত্ত্বে চলে আসলো। এরপর শুরু হল প্রযুক্তির উন্নয়ন। ডগেরোটাইপ ছিল পজিটিভ প্রসেস, অর্থাৎ সরাসরি মুল ছবিটিই চলে আসতো পর্দায়, যদিও এক্সপোজার টাইম ছিল অনেক বেশি। পরবর্তীতে দেখা গেল, ছবির উল্টো ছবিটা (অর্থাৎ নেগেটিভ) অনেক দ্রুতগতিতেই পর্দায় ধরা পড়ে। এটা জানার পর, এক্সপোজার টাইম অনেক কমে গেল, একটা ছবি তোলার জন্য কাউকে আর ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হতো না ক্যামেরার সামনে। ১৮০০ সালের শেষের দিকে জর্জ ইস্টম্যান উদ্ভাবন করলেন একধরনের ফিল্ম যেটাকে রোল আকারে পেঁচিয়ে ক্যামেরায় ভরে ফেলা যেত। ব্যাস! ক্যামেরা হয়ে গেল এইবার মানুষের হাতের নাগালের বিষয়, পোর্টেবল। জগতখ্যাত ‘ইস্টম্যান কোডাক’ তারই গড়া কোম্পানী।
Image4-eastman-kodak
 ছবি ৪: জর্জ ইস্টম্যানের ডিজাইন করা ক্যামেরা। সূত্র:  উইকিপেডিয়া।
এরপর সময়ের সাথে সাথে ক্যামেরা এবং ফিল্মের অনেক ধরনের মডিফিকেশন হয়েছে…ছোট ক্যামেরা, দ্রুত গতির ক্যামেরা, বেশি বা কম আলোকসংবেদী ফিল্ম, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মুল প্রসেস সেই একই।
আর তারপর? দুনিয়াটাই তো ডিজিটাল হয়ে গেল। ডিজিটাল ক্যমেরা কিভাবে কাজ করে সেটা বলবো পরে। প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরার ছবি দিয়ে লেকচারের এই অংশ শেষ করছি।
image 5- first-digital-camera-ever
ছবি ৫: স্টিভ স্যাশনের আবিষ্কৃত ইলেকট্রনিক ক্যামেরা। তিনি ছিলেন ইস্টম্যান কোডাক কোম্পানীর একজন ইঞ্জিনিয়ার।
ফিল্ম প্রসেস:
ভেবেছিলাম বিশদ আলোচনা করি। পরে দেখলাম আমি নিজেও খুব একটা বুঝিনা, আর যেহেতু ফিল্ম ফটোগ্রাফী নিয়ে খুব একটা কথা বলবো না, আগেই বলেছি, কাজেই আর সেধে পড়ে আর এই বিপত্তি ঘাড়ে নেব কেন বলুন! তার চেয়ে সংক্ষেপে একটু বলি সাদাকালো ফিল্ম প্রসেস এর কথা:
১. ফিল্ম এর উপর থাকে ‘সিলভার হ্যালাইড’ নামের একটা রাসায়নিক যৌগের আস্তর।
২. যখন এই ফিল্মের উপর একটা দৃশ্যের আলোকে ফোকাস করা হয়, তখন আলোকসংবেদী এই সিলভার হ্যালাইড বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভেঙে সিলভারে পরিনত হয়। দৃশ্যের যেখানে খুব একটা আলো নেই, সেখানে বিক্রিয়ার মাত্রাও হয় খুব কম। আর অন্ধকার অংশগুলিতে কোন বিক্রিয়া হয় না, সিলভার হ্যালাইড অবিকৃত থেকে যায়।ছবি তোলার পর ফিল্মকে বলা হয় ‘এক্সপোজড (Exposed) ফিল্ম’।
৩. এই ‘এক্সপোজড’ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট এর সময় আর একটি রাসায়নিক দ্রবন ব্যবহার করা হয়, যা ফিল্ম থেকে অবিকৃত সিলভার হ্যালাইড কে সরিয়ে ফেলে শুধু মাত্র সিলভারকে রেখে দেয়। কাজেই শেষ পর্যায়ে আমরা পাই একটা ফিল্ম যেখানে আলোর তীব্রতার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পরিমানে সিলভার জমা হয়ে আছে। নেগেটিভ এ উজ্জ্বল আলো পড়া অংশগুলো অনেক সিলভার জমার কারনে ডার্ক হয়ে থাকবে।এবার এই নেগেটিভ ইমেজের ভেতর দিয়ে আলো ফেলতে হবে আলোক সংবেদী ‘ফটোপেপার’ এর উপর। আলোর তীব্রতার উপর ভিত্তি করে প্রকৃত ছবিটা ফুটে উঠবে কাগজে।
ডিজিটাল প্রসেস:
মূল পার্থক্য খুব সহজ। ফিল্ম ক্যামেরায় যেখানে ছবি ধারন করা হয় রাসায়নিক বিক্রিয়ার ‘এন্ড প্রোডাক্ট’ হিসেবে, সেখানে ডিজিটাল ক্যামেরা ছবি ধারন করে ‘বাইনারী ডাটা’ হিসেবে। অর্থাৎ ডিজিটাল ক্যামেরাগুলোর মধ্যে থাকে একটা ছোট কম্পিউটার, যা লেন্স এর মধ্যে দিয়ে প্রবেশকরা আলোর তীব্রতাকে বাইনারী সংখ্যার একটা সিরিজ হিসেবে রেকর্ড করে। কাজেই, ফিল্মের বদলে ডিজিটাল ক্যামেরায় থাকে একটা ইলেকট্রনিক সেন্সর। এই সেন্সরে বসানো থাকে হাজার হাজার অতিক্ষুদ্র ‘সেল’, যারা আলোর তীব্রতাকে ইলেকট্রনিক চার্জে রুপান্তরিত করে। যেহেতু একটা দৃশ্যে নানা রকম তীব্রতার আলো থাকে, কাজেই সেন্সরের প্রতিটি সেলই ভিন্ন ভিন্ন তীব্রতার আলো ‘রিসিভ’ করবে এবং ফলশ্রুতিতে ভিন্নমাত্রার চার্জ উৎপন্ন হবে প্রত্যেক সেল এ। সব সেল থেকে এই চার্জের তীব্রতার মাত্রা রেকর্ড এবং প্রসেস করেই ‘Final image’ তৈরী হয়। মূলতঃ দুইরকম সেন্সর আছে; সিসিডি (CCD) এবং সি-মস (CMOS). দু’জনেরই মূল কাজই এক, কিন্তু ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস এর ভিন্নতার কারনে সিসিডি ছবির মান অনেক ভাল দেয, তবে শক্তি খরচ করে সি-মস এর তুলনায় অনেক বেশী। এই কারনে বর্তমানে বেশিরভাগ ডিজিটাল ক্যামেরাতেই সি-মস সেন্সর ব্যবহৃত হয়, যদিও জ্যোর্তিবিদ্যা কিংবা অন্যান্য গবেষনামূলক কাজে সিসিডি সেন্সর গুরুত্বপূর্ণ।
পুরো ব্যপারটি আরো জটিল; যেমন ছবির বিভিন্ন অংশের রং এর তথ্য ধারনের জন্যে সেন্সরের উপর একটা ‘বেয়ার ফিল্টার’ বসানো থাকে। এই ব্যপারটি আলোচনা করলাম না জটিলতা এড়ানোর জন্যে।
Image 6-3sensors
ছবি ৬: ডিজিটাল ক্যামেরা’র সেন্সর।
ডিজিটাল ক্যামেরাই এখন ফটোগ্রাফীর মূল মাধ্যম, যদিও অনেকে শখের বশে এখনও ফিল্ম নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে থাকেন। যেকোন নতুন প্রযুক্তির মতই ডিজিটাল ক্যামেরাও খুব উৎসাহের সাথে গৃহীত হয়নি অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফারদের কাছে, অনেকেই এর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এই একটি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির উৎকর্ষ দেখার মতো। মাত্র কয়েকবছরেই এই ক্যামেরাগুলোর ছবির মান ফিল্ম কে ছাড়িয়ে গেছে। এখন নতুন পুরানো প্রায় সব ফটোগ্রাফারই ডিজিটালে ছবি তোলেন। আর কেনই বা তুলবেন না? ছবি তোলার সাথে সাথে দেখা যাচ্ছে, আশানুরুপ না হলে মুছে ফেলা যাচ্ছে। এক্সপেরিমেন্ট এর সুযোগ অফুরন্ত! শুরুতে ডিজিটালের ছবির ‘মেগাপিক্সেল’ (পরে আলোচনা করা হবে) খুব একটা বেশি ছিলনা, কাজেই খুব বড় প্রিন্ট করা যেতনা। এখন মেগাপিক্সেল এবং সেন্সর সাইজ বেড়েছে, ছবি বড় করে প্রিন্ট করার প্রযুক্তিও উন্নত হয়েছে। একটা ৩০ ফুট X ৩০ ফুট বিলবোর্ডে ও ৮ থেকে ১০ মেগাপিক্সেল এর ছবি খুব ভালভাবেই ফুটিয়ে তোলা যায়। ডিজিটালের এই অব্যহত আগ্রাসনের কারনে কোম্পানীগুলো ফিল্ম তৈরী করা বন্ধ করে দিচ্ছে একে একে। ক্যানন, নাইকন এবং অন্য কোম্পানীগুলো আর ফিল্ম ক্যামেরাও তৈরী করছেনা। কাজেই বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পৃথিবী প্রস্তুত ডিজিটাল ফটোগ্রাফীর জন্যে, সেকথা জোর দিয়েই বলা যায়।
সৃষ্টিশীলতা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ফটোগ্রাফী:
“দোস্ত, হলে দেখি গিটারবাদকের অভাব নাই। দুইমাস গিটার শিখে, তারপর ঘ্যাচিং ঘ্যাচিং কি জানি বাজায়, আর বেসুরা গলায় গান গায়।”
“দোস্ত, সবার হাতে হাতে দেখি ক্যামেরা। তোরা ক্যামেরা দিয়া হুদাই ভাব নিস। আমি একটা কিনি, আমিও ছবি তুলুম।”
“মনির, ক্যামেরার ক্রেজ গেছে গা। এখন সবাই বাইসাইকেল কিনতে চায়। এইটাই নতুন ফ্যাশন।”
জ্বি হ্যা। এই কথাগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে শোনা। আমার ধারনা আপনারাও শুনেছেন একই ধরনের মন্তব্য। কিন্তু দেখুন, এত গিটারবাদক আশে পাশে, তারপরও আইয়ুব বাচ্চুর মত গিটারকে কয়জন কাঁদাতে পারে? একবার এক কনসার্টে ওনার গিটারের কাজ হা করে দেখছিলাম, কেমনে করে আন্দাজ করারও চেষ্টা করিনি। স্টিভ ম্যককারির আফগান গার্ল তো শুধুই একটা ছবি, তারপরও সেই ছবি কি করে সারা দুনিয়ায় আলোড়ন তোলে? অথবা ধরুন নিক আট এর তোলা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সেই ছবি, যেখানে একটা বাচ্চা মেয়ে প্রাণের ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল নাপাম বোমার ভয়ে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে এই ছবি অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিল।
Sharbat_Gula
ছবি ৭: আফগান গার্ল। ফটোগ্রাফার: স্টিভ ম্যাককারী
Vietnam Napalm 1972
ছবি ৮: নাপাম গার্ল, ফটোগ্রাফার: নিক আট, ১৯৭২.
adams_moon_and_half_dome
ছবি ৯: মুনরাইজ, ফটোগ্রাফার: অ্যানসেল অ্যাডামস। আজো শত শত ফটোগ্রাফার এই ফ্রেম তোলার জন্যে বছরের একটা বিশেষ সময়ে নিদৃষ্ট একটা জায়গায় জড়ো হয়।
আমার মতে সৃষ্টিশীলতা হচ্ছে সেই বস্তু যা আমাদেরকে অন্য সকল প্রাণী থেকে বিশেষ ভাবে আলাদা করেছে। আর শিল্প বা আর্ট হল একটা বৈশ্বিক ভাষা যা সমস্ত প্রচলিত ভাষার বাঁধা পেরিয়ে (যেটাকে আমরা বলি Language barrier) দেশ জাতি নির্বিষেশে সকল মানুষের কাছে একটা সত্যকে, অথবা একটা মেসেজকে পৌছেঁ দেয়। সব মানুষের মধ্যেই কম বেশি সৃষ্টিশীলতার চর্চা থাকে; সবাই চায় তার কাজে নিজস্বতার একটা ছোঁয়া রাখতে। একটা পর্যায়ে মানুষ উপলব্ধি করে যে ঠিক মুখের ভাষা দিয়ে ভূগলের বাঁধা পেরুনো যায় না।
PicassoGuernica
ছবি ১০: গুয়ের্নিকা, যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরে শিল্পী পাবলো পিকাসো’র প্রতিবাদী কাজ।
কেন জানি মনে হয়, ফটোগ্রাফী বা গিটারের শুরুটা তুলনামূলকভাবে সহজ। পেইন্টিং এর শুরুটা অনেক কঠিন মনে হয় আমার কাছে, তবে অনেকে দ্বিমত পোষন করতে পারেন। শুরুটা সহজ বলেই এই মাধ্যমগুলোতে উৎকর্ষ সাধন ততটাই কঠিন। ফটোগ্রাফীর পুরো প্রসেস এর একটা ক্ষুদ্র অংশ হচ্ছে ক্যামেরার শাটার এ চাপ দেয়া। এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ফটোগ্রাফার এর ভিশন…ব্যপারটা অনেকটা আপনার কল্পনাশক্তি, বিষয়বস্তু খুঁজে বের করার প্রখর দৃষ্টি এবং সঠিক মুহুর্তে ক্লিক করতে পারা- এই গুণগুলোর সংমিশ্রণ বলে মনে করতে পারেন। এবং এই বিষয়গুলো চাইলেই সহজে, বা খুব দ্রুত আয়ত্ত্ব করে ফেলা যায় না। হেনরি কার্টিয়ের ব্রেসন বলেছেন “আপনার প্রথম ১০,০০০ ছবি হলো আপনার তোলা সবচেয়ে খারাপ ছবি।” তা এই ডিজিটালের যুগে দশহাজার কে দশ দিয়ে গুণ করে ফেলা যায়, কি বলেন? নাকি একশ দিয়ে গুণ করবো?
তো মোদ্দা কথা হলো, অন্য সব আর্ট ফর্মের মতই, ফটোগ্রাফীও একটা সাধনার বিষয়। সময় লাগে, শ্রম লাগে এবং ভালবাসা তো অবশ্যই লাগে। একটা সাধারণ বিষয থেকে অসাধারন ফ্রেম বের করে আনার দক্ষতা অর্জনের জন্যে গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে চোখ দিয়ে একটা ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট খুজেঁ বের করার চর্চাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যপারটি আয়ত্ত্ব হয়ে গেলে ক্যামেরার টেকন্যিকাল বিষয় গুলো আপনিই হাতে চলে আসবে। যদি ক্যামেরার সব কন্ট্রোল বোঝার পরও ছবি তোলার উপযোগী বিষয় চোখের নাগালে আনতে না পারেন, তাহলে যেই ছবি হবে সেগুলো স্ন্যাপশট, আপনার মননশীলতার ছোঁয়া থাকবে না তাতে।
এই সেকশানের কথাগুলো কেমন জানি অসংলগ্ন হয়ে গেল। তারপরও যদি এই আলোচনা আপনাদের চিন্তার খোরাক যোগায়, সেটাই যথেষ্ট।
ফটোগ্রাফীর শ্রেণীভেদ (Genre)
বড়ই গোলমেলে ঠেকে আমার কাছে এই শ্রেণীবিন্যাস ব্যপারটা। সবচেয়ে অসহায় লাগে যদিও অণুজীব বিজ্ঞানের খুটিনাটি শ্রেণীবিন্যাস মনে রাখতে গেলে…সেদিক দিয়ে আলোকচিত্রের শ্রেণীভেদ অনেক সহজ! আলোকচিত্রের শ্রেণীবিন্যাস কে দু’টো ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে দেখা সম্ভব। এক হল ‘ফটোগ্রাফ’ এর শ্রেণীবিন্যাস। আর এক হলো ‘ফটোগ্রাফার’ এর রকমভেদ, তথা পেশাগত পার্থক্য। এই দু’রকমকে অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন, এই জন্যে আলাদা করে দিলাম।
ফটোগ্রাফ এর রকমভেদ: যেমন ধরুন-
* ল্যান্ডস্কেপ: সাধারণতঃ প্রকৃতির ছবি, অনেক বড় যার বিস্তার। ছবিতে প্রাণীর চেয়ে প্রকৃতির মূল উপাদানগুলো যেমন আকাশ, পানি, সমুদ্র…এই বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। আবার অনেকে তোলেন ‘আরবান ল্যান্ডস্কেপ’, যেখানে শহরের জড় উপাদানগুলোও ছবি তে আসতে পারে।
ছবি ১১: ল্যান্ডস্কেপ; ফটোগ্রাফার: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
* পোরট্রেইট: ছবির মুখ্য বিষয় মানুষ, মানুষের মুখ। সাধারণতঃ একজন বা কয়েকজন মানুষের মুখের ছবি, যা তাদের ব্যক্তিত্বের কোন বিশেষ একটি দিক তুলে ধরে।
ছবি ১২: পোরট্রেইট; ফটো: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
* ম্যাক্রো: খুবই কাছথেকে নেয়া ডিটেইল এর ছবি। ম্যাক্রো ছবির সাবজেক্ট অনেককিছুই হতে পারে..পোকামাকড় থেকে শুরু করে একটা জড়বস্তুর কোন একটা অংশের ক্লোজআপ। ম্যাক্রো ছবি তোলার জন্যে খুব কাছ থেকে ফোকাস করতে পারে, এমন লেন্স প্রয়োজন হয়।
ছবি ১৩: ম্যাক্রো; ফটো: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
* অ্যাকশন: যে ছবিতে খুব দ্রুতগতির কোন সাবজেক্ট কে তুলে ধরা হয়। সেটা হতে পারে দ্রুতগামী কোন গাড়ি, অথবা কোন দৌড় প্রতিযোগিতার মূহুর্ত, ইত্যাদি।
ছবি ১৪: এ্যাকশন; ফটো: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
* স্টিল লাইফ: জড়বস্তুর ছবি যেটা আলো ছায়ার কারুকাজের কারণে একটা আবহ তৈরী করে।
ছবি ১৬: স্টিল লাইফ; ফটো: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
পেশাগত দিক থেকে বলতে গেলে ফটোগ্রাফীর প্রচুর রকমফের আছে। ফ্যাশন, ইভেন্ট, আর্কিটেকচারাল, ওয়েডিং, স্পোর্টস, ওয়াইল্ডলাইফ, লাইফস্টাইল…ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়া একটা জনপ্রিয় বিষয় হলো স্ট্রিট ফটোগ্রাফী, যেখানে ফটোগ্রাফাররা রাস্তায় চলতে চলতে স্বতস্ফুর্ত (candid) মূহুর্তগুলোর ছবি তোলার চেষ্টা করেন। তবে একটা জিনিস খেয়াল রাখবেন। যেই ধরনের পেশাদার ফটোগ্রাফারই হোন না কেন, তারা যেই ছবি গুলো তোলেন, সেগুলো ল্যান্ডস্কেপ থেকে শুরু করে ম্যাক্রো, সবধরনেরই হতে পারে। যেমন ধরুন একজন স্পোর্টস ফটোগ্রাফার অ্যাকশন ছবি যেমন তোলেন, তেমনি একজন প্লেয়ার এর পোরট্রেইট ও তোলেন।
17888_10151360576016811_1178935075_n
ছবি ১৭: ফ্যাশন; ফটোগ্রাফার: আবির আবদুল্লাহ
সাংবাদিকতায় ফটোগ্রাফী: (Photojournalism)
সংবাদমাধ্যমে, বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়ায় ফটোগ্রাফীর গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনই উপায় নেই। কোন এক বিচিত্র কারনে মানুষ ছবি দেখতে খুবই পছন্দ করে। কলামের পর কলাম জুড়ে লেখা একটা খবর যতখানি মানুষের কাছে আবেদন তৈরী করে, তার থেকে অনেক বেশি চোখে আটকে যায় একটা ছোট্ট ছবি।
আমার মতে সাংবাদিকতায় ফটোগ্রাফীর প্রয়োজন দুই ধরনের। এক হল,  যখন ছবি একটা খবরকে আরো বেশি স্পষ্ট ভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরে।আর এক হল, যখন ছবি নিজেই গল্পটা বলে। পত্রিকায় দেখবেন প্রায়ই একটা ছবির সাথে একটা ছোট্ট লাইন জুড়ে একটা খবর দেয়া হয়ে যায়। নিচের ছবির কথাই ধরুন। অদ্ভুত তাই না? এই ছবির আবেদন অত্যন্ত তীব্র; হয়তো একটা ছোট ক্যাপশন দরকার হবে যারা ঘটনা সম্পর্কে জানে না তাদের জন্যে, অন্যথায় ক্যাপশনও প্রয়োজন নেই।
image-17-rahul talukder
ছবি ১৮: ফটোজার্নালিজম (রানা প্লাজা’র ভয়াবহ দুর্ঘটনার ফলোআপ); ফটোগ্রাফার: রাহুল তালুকদার
অন্য যেকোন পেশাজীবি ফটোগ্রাফার থেকে ফটোসাংবাদিকের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। আমরা সবাই জানি আলোকচিত্র মূলতঃ ফটোগ্রাফারের নিজের দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ। সব ফটোগ্রাফার এরই স্বাধীনতা আছে নিজের তোলা ছবিকে প্রয়োজনীয় (অথবা খেয়ালখুশীমত) পরিবর্তন করে ‘ফাইনাল আউটপুট’ টি সবার সামনে তুলে ধরার। কিন্তু ফটোসাংবাদিকের এই স্বাধীনতা নেই। ফটোসাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব হল প্রকৃত ঘটনাকে অবিকৃত অবস্থায় ছবি তে তুলে ধরা, ছবির কোন অংশ কোনভাবেই মুছে ফেলা বা ছবি তোলার পর তাতে কোন কিছু যোগ করা যাবে না। আপনি শখের ফটোগ্রাফার, আপনার ছবির আকাশে দু’টো পাখি জুড়ে দিলেন, সেটা আপনার অধিকার। কিন্তু ফটোসাংবাদিকের আকাশে যদি কোন পাখি না থেকে থাকে, সেটাই সত্যি, সেটাই দেখাতে হবে।

No comments:

Post a Comment

Thank you very much.