ফটোগ্রাফী একটি শিল্প, একটা ফটোগ্রাফের মূল উপাদানগুলো কি কি? আসুন একটু বিশ্লেষনের চেষ্টা করি:
১. বিষয়বস্তু (কিসের ছবি তুলছেন?)
২. মুহূর্ত (সঠিক সময়ে ক্লিক করতে পেরেছেন কি না। কারো কান্নার ছবি তুলবেন, অথচ এমন সময় ক্লিক করলেন যখন সে ঠিক কান্না কান্না মুখ করে নেই, সেটাকে সঠিক মোমেন্ট বলা যাবে না)।
৩. কম্পোজিশন (ফ্রেমের ভেতর বিষয়বস্তু কিভাবে সাজিয়েছেন)।
৪. আলো (ঠিক যায়গায় ঠিক মতো আলো আছে কি না, অতিরিক্ত আলোর কারণে ছবির কোন অংশ জ্বলে গেছে কি না ইত্যাদি)।
এবার আসুন রা্ন্নার ফরমুলা প্রয়োগ করার চেষ্টা করি। ছবির বিষয়বস্তু খুবই ইন্টারেস্টিং বা গুরুত্বপূর্ণ। ছবির কম্পোজিশন, মোমেন্ট এবং আলো একদম পারফেক্ট। ব্যস, এই ছবি হয়ে যাবে একটা মাস্টারপিস। মানুষ তাকিয়ে থাকবে, মনে রাখবে, আপনার ছবি নিয়ে অনেক আলোচনা হবে। একটা সত্যিকারের ভাল ছবি।
এবার ধরুন, ছবির বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাড়াহুড়ায় ছবির কম্পোজিশন টা ভালো হলো না। কম্পোজিশনের কিছু কায়দা কানুন আলোচনা করবো এই অধ্যায়ে, কাজেই ভাল/খারাপ কম্পোজিশন সম্পর্কে ধারণা হবে খুব শিগগির। যাই হোক, খুবই ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট, কিন্তু কম্পোজিশন ভাল না হওয়ার কারণে ছবিটা হয়তো খুব একটা সাড়া ফেলতে সক্ষম হবে না। ছবিটাকে খারাপ বলা যাবেনা যদিও, কেননা এটা হয়তো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ধরে রাখতে সক্ষম হযেছে।
ভাল ছবির সংজ্ঞা দেয়া খুবই মুশকিল। আজকে আমি ফটোগ্রাফীর সব গ্রামার মেনে একটা ল্যান্ডস্কেপ তুললে সেটা হয়তো আপনি ছুড়ে ফেলে দেবেন, কিন্তু একই বিষয়ের ছবি যদি অ্যানসেল অ্যাডামস তোলেন তাহলে সেটাকেই বুকে তুলে নেবেন। কেন? আরে অ্যানসেল অ্যাডামস এর ছবি যে! কোথাকার কোন যদুমধু মনিরের ছবি কে দেখবে? ঠিক। কোন ছবি ভাল না ‘অ্যাভারেজ’, সেটা অনেকাংশেই কিন্তু দর্শক ঠিক করেন। আর সেই বিবেচনা অনেকাংশেই প্রভাবিত হয় ফটোগ্রাফার এর পরিচয় দ্বারা। এই কথা সব ধরনের আর্টের ক্ষেত্রেই খাটে। পাবলো পিকাসো নাকি ক্যানভাসে শুধু সাদা রং করতেন আর সেই ক্যানভাস হাজার হাজার ডলারে বিক্রি হতো। যাই হোক। ফটোগ্রাফার যেই হোন না কেন, ছবি ভাল হওয়ার কিছু শর্ত তো আছেই, আর সুখের কথা হলো সেই শর্ত গুলো নিয়ন্ত্রন করার জন্য বিখ্যাত ফটোগ্রাফার হওয়ার দরকার নেই। আমরা সবাই সেটা করতে পারি।
কম্পোজিশন, অর্থাৎ ফ্রেমের ভিতর বিষয়বস্তুর বিন্যাস ছবির মানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। কম্পোজিশনের কিছু ব্যকরণ আছে যেগুলো আমি নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করবো এই অধ্যায়ে। ভাল করে যখন ব্যকরণ শিখে যাবেন, তখন নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট করুন, ব্যকরণ ভেঙ্গে ফেলুন ঠিক আছে, কিন্তু আগে সেই ব্যকরণ শিখতে হবে।
এক নম্বর ব্যকরণ – ক্যামেরা বাস্তবতাকে ধারন করে না
ক্যামেরা যে ছবি তোলে তা কখনই আপনার দেখা বাস্তবতাকে ধারণ করেনা, কারণ:
১. আমরা দুই চোখে পৃথিবী দেখি, ক্যামেরা দেখে এক চোখে। দ্বিনেত্র দৃষ্টি আর একনেত্র দৃষ্টির পৃথিবী অবশ্যই আলাদা।
২. আমরা যখন কোন কিছু দেখি, তখন আমাদের মনোযোগের কেন্দ্র ছাড়াও আশে পাশের অনেককিছু আমাদের ব্রেইন ধারণ করতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যখন রাস্তা পার হবেন তখন আপনার দৃষ্টি থাকে জেব্রা ক্রসিং বা রাস্তার অপর পারের দিকে। কিন্তু ওই মুহুর্তে যদি কোন একটা গাড়ি অন্যপাশ থেকে নিয়ম ভেঙ্গে আসতে থাকে, সেটা আপনার চোখের কোণে কিন্তু ঠিকই ধরা পড়বে (যদি না আপনি আকাশকুসুম কল্পনায় ডুবে থাকেন) আর সাথে সাথে আপনি লাফ দিয়ে সরে যাবেন। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে যখন আমরা চোখ রাখি, তখন এই ‘পেরিফেরাল ভিসন’ কে আমরা সীমাবদ্ধ করে ফেলি, ভিউ ফাইন্ডারের বাইরের কোন কিছুই কিন্তু ছবিতে ধরা পড়ে না। অর্থাৎ ছবিতে আমরা যা ধারন করি, তা ওই মুহুর্তের বাস্তবতার একটা অংশ মাত্র, পুরোটা কোনভাবেই নয়।
৩. আমাদের চোখএর ‘ডাইনামিক রেঞ্জ’ (অর্থাৎ আলো আঁধারের বিভিন্ন মাত্রাকে পৃথক করার ক্ষমতা) যে কোন ক্যামেরার সেন্সরের চেয়ে অনেক বেশি। কোন একটা অন্ধকার ঘরে আপনি হয়তো অনেক কিছু দেখতে পাবেন, কিন্তু অনেকখানি সময় নিয়ে এক্সপোজ না করলে ক্যামেরা কিছুই দেখবে না। সূর্য যখন সুন্দরবনের উপর অস্ত যায়, তখন আপনি একই সাথে উজ্জ্বল সূর্য আর তুলনামূলক ভাবে অন্ধকার সুন্দরবনের ডিটেইলস দেখতে পারবেন, কিন্তু ক্যামেরা গুবলেট করে ফেলবে…সূর্যের ডিটেইলস ঠিকমতো আসলেও বন দেখাবে অন্ধকার। একই সাথে দুই ভিন্ন মেরুর ডাইনামিক রেঞ্জ ধারণ করার ক্ষমতা ক্যামেরার নেই।
৪. পার্সপেক্টিভ (Perspective) বা দৃষ্টিকোণ। ধরুণ আপনার উচ্চতা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি। আপনি সোজা দাড়িয়ে যেই ছবি তুলবেন, সেই ছবির দৃষ্টিকোণ কখনোই একজন ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার ফটোগ্রাফারের একই ভঙ্গিমায় তোলা ছবির সাথে পুরোপুরি মিলবে না। হাস্যকর শোনালেও সত্যি। আসলে আমরা সবাই আলাদা আলাদাভাবে পৃথিবীকে দেখি আর চেষ্টা করি ফটোগ্রাফের মাধ্যমে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বাকি সবার কাছে তুলে ধরার।
দু্ই নম্বর ব্যকরণ: ক্যামেরার ফ্রেম এর ভিতর বিষয়বস্তু কিভাবে সাজানো থাকবে তা ফটোগ্রাফার নিয়ন্ত্রন করেন
আগেই বলেছিলাম ক্যামেরার একটা ব্রেইন আছে, আর সেই ব্রেইন হলেন আপনি। এক নম্বর ব্যকরণের দুই নম্বর পয়েন্ট টা আবার দেখুন। যেই মুহুর্তে আমরা ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখি, তখন আশে পাশে কি ঘটছে না ঘটছে কিছুই আর মুখ্য নয়। ফ্রেমের ভিতর যা ঘটছে, তাই ছবিতে থেকে যাবে, তা নিয়েই হবে যত আলোচনা সমালোচনা। আপনার ফ্রেমের ভেতর একটা ফুল ফুটতে পারে, কিন্তু ঠিক ফ্রেমের বাইরেই হয়তো একটা গ্রেনেড পড়ে আছে। এখন এই গ্রেনেড কে আপনি একই ফ্রেমে রাখবেন, নাকি পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেবেন, সেটা আপনার সিদ্ধান্ত। গ্রেনেড সহ এই ছবি একরকম মেসেজ দেবে, আর গ্রেনেড ছাড়া আর একরকম। কাজেই, ছবি তোলার সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে, সেটা হলো ঠিক ফ্রেমের ভেতরকার জিনিসগুলোকে কিভাবে সাজাবেন। আশে পাশে কি ঘটছে তা মাথায় না রাখলেও চলবে।
To photograph is to hold one’s breath, when all faculties converge to capture fleeting reality. It’s at that precise moment that mastering an image becomes a great physical and intellectual joy. – Henry Cartier-Bresson
তিন নম্বর ব্যকরণ: সরলীকরণ (Simplification)
পৃথিবীটা যথেষ্ট জটিল। সাত বিলিয়ন মানুষ, অগুণিত বিল্ডিং, হাজারো চ্যাঁচামেচি, গাদাগাদা গাড়িঘোড়া আর ফুটপাথে বেহেশতি জেওর আর সস্তা চটিবইয়ের সম্মিলিত সমাহার আমাদের মাথা বনবন করে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। কাজেই দর্শক যখন আপনার ছবি দেখবেন, তখন তারা আশা করেন সহজ, সরল একটা ফ্রেম। একটা ছবি যা একটি নিদৃষ্ট বিষয় কে তুলে ধরে। নানারকম হিজিবিজির ভিড়ে যদি আপনার ছবির মূল বিষয়টি হারিয়ে যায়, তাহলে ছবি তার আবেদন হারাবে।
এই ছবিটি দেখুন। একটা নৌকা, নৌকার নাবিকেরা আর অস্তগামী সূর্য। আর কিছু নেই। আশেপাশে আরো দুই একটা নৌকা ছিল, আরো মানুষ ছিল। সেগুলো বাদ দেয়া হলো কেন? সবকিছু একসাথে থাকলে আরো জমজমাট একটা ফ্রেম হতো না? হতো হয়তো। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল ‘অভিযাত্রী’ theme এ একটা ছবি তোলা; একটা যাত্রা যা কখনও শেষ হয় না। কাজেই সূর্য কে ফ্রেম এ রাখা হলো আর নৌকার সামনের দিকটা রাখা হলো পুরো ফাঁকা, যাতে দর্শক ইচ্ছামতো কল্পনা করে নিতে পারে একটা অনন্ত ভ্রমনের কথা, যার গন্তব্য জানা নেই। ছবিটা দিয়ে আপনি কি মেসেজ দেবেন, অথবা নিদেনপক্ষে কি দেখাবেন, সেটা আগে ঠিক করুন। তারপর শুধু সেই বিষয়টিকেই ছবিতে রাখুন। ফ্রেমের আশপাশ থেকে যদি ‘out of context’ বিষয়বস্তু উকিঁ দিতে থাকে, তাহলে ছবিটি কখনোই সফল হবে না – দর্শকের চোখে আশে পাশের জিনিসের দিকে চলে যাবে, মূল বিষয় তার আবেদন হারাবে।
এই ছবিতে অনেককিছু আছে। দোকানপাট, নদীর ধারে শুকাতে দেয়া রঙ্গিন সব পাপোষ, রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যাওয়া একজন মহিলা আর একটা রিকশা। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, এতকিছু থাকার পরও চোখ চলে যায় হেঁটে যাওয়া কমলা শাড়ি পরা মহিলার দিকে। মহিলার আশে পাশে যদি আরো পথচারী থাকতো, তাহলে ছবিটা গোলমেলে হয়ে যেত, হয়ে যেত একটা ‘সিটিস্কেপ’ জাতীয় কিছু। কিন্তু সেটা নেই বলে এত কিছু থাকার পরও ফ্রেমে এই মহিলাই কিন্তু দর্শকের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করবেন।
যতটুকু সম্ভব ফ্রেম থেকে অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দেয়ার চেষ্টা করুন। যদি সিচুয়েশন আপনার নিয়ন্ত্রনে থাকে (যেমন কারো পোরট্রেইট বা স্থির কোন বিষয়ের ছবি), তাহলে সময় নিয়ে ভাবুন এবং ফ্রেমটি কম্পোজ করুন। আর যদি আপনার নিয়ন্ত্রনে না থাকে (যেমন উপরের ছবিটির মতো স্ট্রিট ফটো তোলার সময়), তাহলে উপযুক্ত মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করুন। ক্যামেরার লেন্স তাক করে ভিউফাইন্ডার দিয়ে ধৈর্য ধরে তাকিয়ে থাকুন, যেই মুহুর্তে দেখবেন ফ্রেম এ কোন অপ্রয়োজনীর বিষয় প্রবেশ করছে না, তখন ক্লিক করুন।
চার নম্বর ব্যকরণ: ফ্রেম এ ভারসাম্য (balance) রক্ষা করুন
ফ্রেমের ভিতর বিষয়বস্তুগুলোকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন তা দর্শকের চোখকে কোনভাবে বিভ্রান্ত না করে।
ক) গোল্ডেন রেশিও (Golden ratio):
ভারসাম্য রক্ষার অনেকগুলো নিয়ম আছে, তবে সবচেয়ে আলোচিত, পৃথিবী বিখ্যাত নিয়ম বোধ হয় ‘Golden ratio’. দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমি এখানে এই গোল্ডেন রেশিও নিয়ে কোন বিশদ আলোচনা করবো না। এই অনুপাতের মধ্যে কিছুটা অংকের ব্যপার স্যপার আছে, যেটা বোঝার কোন দরকার নেই, প্রয়োগটা বুঝলেই চলবে।
যেকোন ছবিতেই সাধারণতঃ দুইটি প্রধান তল থাকে – ফোরগ্রাউন্ড (সামনের তল) এবং ব্যাকগ্রাউন্ড (পেছনের তল)| ছবির মূল সাবজেক্ট থাকে ফোরগ্রাউন্ড এ, এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকে অন্যান্য বিষয়বস্তু; পাহাড়, নদী, ঘরের আসবাব ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনি যদি আপনার ফ্রেম এর ভিতরের সবকিছুকে একটা ‘নাটক’ এর অংশ মনে করেন, তাহলে বলা যায় ফোরগ্রাউন্ড এ থাকেন অভিনেতারা, আর ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকে স্টেজ। ছবিতে অবশ্যই মূল সাবজেক্ট প্রাধাণ্য পায়, তবে স্টেজকেও কিছুটা ‘emphasis’ দিতে হয়। গোল্ডেন রেশিও মেনে ছবি তুললে ফোরগ্রাউন্ড এবং ব্যাকগ্রাউন্ডের এই ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। নিচের ছবিদু’টো দেখুন:
ছবি তোলার সময় লম্বালম্বি এবং আড়াআড়ি দুইটা করে কাল্পনিক লাইন টেনে ফ্রেমকে এইরকম নয়টি আয়তক্ষেত্রে ভাগ করে ফেলুন। এরপর মূল বিষয়কে রাখার চেষ্টা করুন লাইনগুলো যেখানে ছেদ করেছে, সেখানে। মোদ্দাকথা হলো, ফ্রেমের ঠিক কেন্দ্রের আয়তক্ষেত্রে বিষয়কে না রাখার চেষ্টা করুন। অবশ্যই অনেক বিবেচ্য বিষয় আছে – আপনি ঠিক কোন পয়েন্টে দর্শকের চোখ আটকে দিতে চান, অথবা কয়টি ‘মূল’ বিষয় আছে আপনার ছবিতে। উদাহরণস্বরুপ, প্রথম ছবিটি একজন মডেলের এবং পুরো ফ্রেমে আর কিছুই নেই মেয়েটির মুখ ছাড়া। কিন্তু যেহেতু ডান চোখের উপর ফোকাস, ফটোগ্রাফার ইচ্ছা করেই এই ফোকাসড বিষয়কে দুইটি লাইনের ছেদবিন্দুতে রেখেছেন। আবার অন্য ছবিটিতে বিশাল ল্যান্ডস্কেপের ঠিক মাঝখানে মডেলকে না রেখে একটু নিচে, ডানদিকে রাখা হয়েছে।
গোল্ডেন রেশিও কে মোটামুটি একলাইনে এভাবে বলা যায়: ফ্রেমের কেন্দ্রে (Center) এ বিষয়বস্তুকে রাখার প্রবণতা পরিহার করুন।
খ) সাবজেক্টের ‘ওভারল্যাপিং’ পরিহার করা:
এই বিষয়টি মাথায় রাখলে বাতিল ছবির পরিমান অনেক কমে যাবে আপনার ঝুড়ি থেকে। ছবি তোলার সময় খেয়াল রাখুন যেন আপনার ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট অন্য একটি সাবজেক্ট দ্বারা ঢেকে না যায়। নিচের ছবিটি দিয়ে ব্যখ্যা করার চেষ্টা করছি:
এই ছবিতে মূল বিষয় হল মানুষ। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন, অনেকগুলো মুখ আংশিক বা পুরোটা ঢেকে গেছে অন্য মুখ দিয়ে, যেটা ছবির আবেদন অনেকটাই ক্ষুন্ন করেছে। কিন্তু একেবারে পেছনদিকে কয়েকটা মুখ একদম স্পষ্ট, আর দেয়ালের ছায়ার মতোন পেইন্টিংটাও ঢাকা পড়েনি, যে কারণে ছবিটি টিকে গেছে। তোলার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন মূল বিষয়গুলো পাশাপাশি বা উপর নিচে থাকে, কোনভাবে যেন সামনের সাবজেক্টের কারণে পিছনের সাবজেক্ট ঢেকে না যায়। আর একটি ছবি দেখুন:
প্রত্যেকটি মেয়ের চেহারা এবং চেহারার এক্সপ্রেশন আলাদা আলাদা ভাবে বোঝা যায়, শুধু একজনের চেহারা আংশিক ঢেকে গেছে, যেটা না হলেই ভাল হতো। এটা ক্যানডিড আর সাজানো ছবির মাঝামাঝি একটা অ্যাপ্রোচ, এবং সাবজেক্ট এর অভিব্যক্তি বা অবস্থান এর উপর আমার খুব একটা নিয়ন্ত্রন ছিলনা। ভিউফাইন্ডারের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে উপযুক্ত মুহুর্তের অপেক্ষা এবং সঠিক মুহুর্তে ক্লিক করতে পারাটা পুরো ফটোগ্রাফিক প্রসেস এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আরো একটা উদাহরণ, যেখানে সচেতনভাবে সাবজেক্ট এর ওভারল্যাপিং পরিহার করা হয়েছে:
এই ছবিটি যদি আর একটু নিচ থেকে তোলা হতো (অর্থাৎ দর্শকরা যেখানে বসে আছে সেই লেভেল থেকে), তাহলে কারো চেহারা আলাদাভাবে ধরা পড়তো না। এ কারণেই একটু উপর থেকে তোলা।
গ) সাবজেক্ট এর ‘দাড়িপাল্লা’:
অদ্ভুত টার্মিনোলোজি। তবে ব্যপারটা কিন্তু দাঁড়িপাল্লার মতোই। যদি আপনার ছবির একদম ডানদিকে একটা সাবজেক্ট থাকে আকারে বড়, তাহলে একদম বামদিকে একটা কিছু রাখুন যা আকারে তুলনামূলক ভাবে অনেক ছোট। কোন একটা অদ্ভুত কারণে এই ধরনের কম্পোজিশন ছবিতে ভাল ব্যালেন্স সৃষ্টি করে। নিচের উদাহরণ দেখুন:
বিশাল বটগাছকে ছোট্ট সাইকেলওয়ালা ছেলেটাকে দিয়ে কিভাবে ব্যালেন্স করা হয়েছে। আমার ধারণা এই ব্যপারটি ঘটে ‘কন্ট্রাস্ট’ বা বৈপরীত্য সৃষ্টির কারণে। আমরা ছবিতে দুইটি ভিন্ন মেরুর বিষয় দেখতে ভালবাসি – একটা অনেক বড় সাবজেক্টের সাপেক্ষে একটা অনেক ছোট বস্তু তাই ছবির মজা বাড়িয়ে দেয়। এইরকম আরো একটি উদাহরণ:
ঘ) সাবজেক্টের সামনের দিকে বেশি তুলনামূলক ভাবে বেশি ফাঁকা যায়গা রাখা
আপনার ছবির সাবজেক্ট যেদিকে আগাচ্ছে/মুখ করে আছে, সেদিকে বেশি ফাঁকা যায়গা রাখুন। স্বাভাবিকভাবেই, দর্শক আপনার সাবজেক্ট এর কর্মকান্ড ‘follow’ করবেন – কাজেই সাবজেক্ট এর চোখ যেদিকে, সেদিকেই দর্শকের চোখ চলে যাবে। যদি সেদিকে স্পেস না রাখেন, তাহলে দর্শকের চোখ ছবির বাইরে থেকে বেরিয়ে ছবি যে দেয়ালে ঝুলানো, সেই দেয়ালের উপর চলে যাবে।
উদাহরণ:
আজকে এই পর্যন্তই। আগামী পর্বে আলোচনা করবো কম্পোজিশনের আরো কিছু দিক, বিশেষ করে প্যাটার্ন সৃষ্টি এবং ভাঙা নিয়ে। আগেই বলেছি, ভাল ছবিতে আসলে বিষয়বস্তু, আলো, কম্পোজিশন সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। এই সবগুলো বিষয়ের সঠিক সমন্বয়ের ব্যপারটি পুরোটাই আপনার হাতে, কাজেই দামী ক্যামেরা মানেই ভাল ছবি এই ধারণা পরিহার করাটা গুরুত্বপূর্ণ। ভাল ছবি তোলার প্রথম ধাপ হচ্ছে ক্যামেরার উপর থেকে বিশ্বাস সরিয়ে নিজের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা।
No comments:
Post a Comment
Thank you very much.