আমাদের একাত্তুরের বীর-বীরঙ্গনা পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামটি লিখে দিয়ে আমাদের দিয়েগেছেন আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদার নিশ্চয়তা । তাঁরা আমাদের স্বাধীনতার বীর সৈনিক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীর সময় অনেক মা / বোন পাকিস্তানী হায়নাদের জুলুম নির্যাতনে তাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন।
স্বাধীন দেশের এক অসহায় বীরঙ্গনা নারী সুইটি আক্তার পুতুলের কেউ কোন খোঁজ খবর রাখেনি, অথচ এদের সম্ভ্রমের বিনিময় আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা,পেয়েছি একটি মানচিত্র,একটি পতাকা। পুতুলের বাবা ইছাহাক আলী ওরফে টেংগরু পরিবার নিয়ে বাস করতেন রংপুর রেলষ্টেশন পীরপুর এলাকায়। ৪ বোন ১ ভাই এর মধ্যে সকলের বড় ছিলো বাবার বড় আদরের মেয়ে পুতুল। দেখতেও পুতুলের মতই ছিলো তার এই ১০/১১ বছর বয়সেই পুরো ৯ মাস পাকিস্তানীদের পাশবিক নির্যাতরে শিকার হতে হয়েছে তাকে। এমন কোন রাত নেই যে বর্বর পশুগুলো তাকে ভোগ করেনি। সেদিনের সেই বিভীষিকাময় ১৯৭১ এর মার্চের শেষের দিকে শহরের পীরপুর এলাকার আব্দুস সাত্তারের ছেলে ওয়াহেদ নামের এক পাকিস্তানী সেনাদের দোসর তাকে বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে যায় রেলষ্টেশনে পূর্ব পার্শ্বে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি দ্বিতল ভবনে।
সেখানে নিয়ে অবস্থানরত পাকিস্তানী হায়েনাদের হাতে তুলে দিয়ে বাহাবা নিয়ে সটকে পরে ওয়াহেদ। প্রথম দিনে ৯ জন হায়েনা পশুর মত ঝাপিয়ে পরে পুতুলের উপর। সারা রাত ধরে সম্ভ্রম হানি করে। অল্প বয়েসে পাশাবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেয়ে এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফিরে পুতুল দেখে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে রংপুর ক্যান্টারমেন্টে। সেখানে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর প্রতিদির রাতেই ভোগ্যপণ্যের মত পুতুলকে ভোগ করেছে খান সেনারা। সম্ভ্রম হানি শেষ হলে হাফফ্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরিয়ে হাত পায়ে শিকল বেঁধে তাকে তালাবন্ধ করে রাখা হতো বড় একটি কাঠের আলমারীতে। গভীর রাতে তাকে নিয়ে যাওয়া হতো বন্ধভূমিতে। সেনারা হত্যাযঞ্জ চালার পর গাড়ীতেই পুতুলকে নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠত। এক সাগর রক্তের বিনিময় দেশ স্বাধীন হয়েছে। ডানহাতে বেয়নেটের আঘাত সহ শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন আর মানষিক যন্ত্রনা নিয়ে আজও বেঁচে আছেন রংপুরের বীরঙ্গনা নারী সুইটি আক্তার পুতুল। শহরে রেলষ্টেশন সংলগ্ন একটি বস্তিতে কোন রকমে মাথা গুজার ঠাই হয়েছে এই বীরঙ্গনার।
কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নের মির্জানগর গ্রামের এক ভাগ্যাহত গৃহবধূ প্রভা রানী মালাকার। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক হানাদারদের স্থানীয় দোশর রাজাকাররা ধরে নিয়ে তুলে দিয়েছিল পাক সেনাদের হাতে। সে সময়ের ১৫ বছরের প্রভা রানী বিক্রম কলস গ্রামে ও শমশেরনগর ডাক বাংলোয় পাক সেনা ক্যাম্পে দু'বার পাক সেনা ও রাজাকারদের হাতে গণ ধর্ষনের শিকার হতে হয়েছিলেন। সেদিন তার সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাক সেনা ও তাদের দোসর রাজাকারদের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিল মীর্জানগর গ্রামের অনেক অসহায় মানুষ প্রাণ ।
কিন্তু স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর অতিবাহিত হলেও সেই হতভাগ্য মহিলার ভাগ্যে জুটেনি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি। পাননি কোন সরকারী সাহায্য সহযোগীতা। ভাগ্যে জুটেছে শুধুই পাঞ্জাবীর বউ বলে এলাকার লোকজনের কটাক্ষ। একমাত্র আধা পাগল ছেলেটার বাদ পড়েনি তা থেকে। গ্রামের মানুষ কটাক্ষ করে ডাকে পাকিস্তানী(পাঞ্জাবীর)-র অবৈধ জারদ সন্তান হিসেবে। কেউ কোন দিন খোঁজ করেননি কেমন আছেন স্বামী হারা প্রভা রানী মালাকার। দুবেলা দু'মুটো ভাতের জন্য গ্রামে গ্রামে ফেরী করে যে আয় রোজগার করেন তা দিয়ে কোন রকমে ছেলে, ছেলের স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বেঁচে আছেন। স্থানীয় ভূমিখেকোদের করাল গ্রাসে দখল হয়ে যাচ্ছে স্বামীর রেখে যাওয়া শেষ ভিটে-মাটিটুকুও।
বৈশাখ মাসে তার বিয়ে হয় আর শ্রাবন মাসে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ব। তখন স্বামী কামিনী রাম মালাকার তাদেরকে রেখে চলে যান ভারতে। তিনিও নিরাপত্তাহীনতার কারণে চলে যান বাবার বাড়ী পাশের গ্রাম বিক্রম কলসে। মাস পনের দিন পর বিক্রম কলস গ্রামের রাজাকার নজির মিয়া ও জহুর মিয়া একদিন গোধুলী লগ্নে প্রভা রাণীকে তার মায়ের সামন থেকে জোর পূর্বক তুলে নিয়ে যায় পাশ্ববর্তী বাদল মাষ্টারের বাড়ী। এক সময় তিনি ভেবেছিলেন দৌড়ে পালাবেন কিন্তু রাজাকার ও পাক সেনাদের হাতে বন্দুক থাকায় গুলিতে মরে যাওয়ার ভয়ে আর পালাননি। যেখানে পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছিল। সে রাতে বাদল মাষ্টারের বাড়ী অবস্থান নেয়া সকল সদস্যরা কেড়ে নেয় তার সম্ভ্রম। পরদিন সকালে আর্মিরা তাকে ছেড়ে দিলে তিনি আশ্রয় নেন তার বোনের বাড়ী জাঙ্গাল হাটি গ্রামে। সেখানে কয়েকদিন আত্মগোপন করে থাকেন। কিন্তু ২০/২৫ দিন পর রাজাকার কাদির, রইছ , ইনতাজ, জহুর আবার পেয়ে যায় তার সন্ধান। শত চেষ্টা করেও প্রভা রানী তাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। যে দিন রাজাকাররা জাঙ্গাল হাটি প্রভা রানীর বোনের বাড়ী হানা দেয় তখন নিজেকে রক্ষার জন্য প্রভা রাণী ধানের বীজ তলার আইলের নীচে আশ্রয় নেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রাজাকার ইন্তাজ, জহুর, রইছ, কাদির সেখান থেকে তাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসে। এ সময় স্থানীয় গফুর মিয়া তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসায় তিনিও তাদের হাতে লাঞ্চিত হন। রাজাকাররা প্রভা রাণীকে ধরে নিয়ে আসার সময় তাদের পালিত কুকুর তার কাপড় ধরে টানতে থাকে। সোনারার দিঘির পার পর্যন্ত কুকুরটি আসার পর সেটিকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
এক সময় প্রভা রাণীকে নিয়ে আসা হয় শমশেরনগর ডাক বাংলায় পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পে। সারা রাত পাকিস্তানী সেনারা তাকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষন করে। নিজেকে বাঁচানোর সকল চেষ্টা করেও তিনি রক্ষা পাননি। অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিলেন পাক সেনাদের কাছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন প্রভা রানী। সারা রাত তাকে ধর্ষনের পর সবাই চলে গেলে ভোর রাতে তিনি সুযোগ বুঝে এক সময় পাক সেনাদের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে কোন রকম হেটে হেটে নিজের বোনের বাড়ী আবার চলে যান। দেশ স্বাধীন হবার এক বছর পর ১৯৭২ সালে তার একমাত্র ছেলে কাজল মালাকারের জন্ম হয়। কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন রিক্সা চালক ছেলেকে কিছু সংখ্যক মানুষ ডাকে পাঞ্জাবির অবৈধ ছেলে হিসেবে। অনেক মানুষ প্রভা রানীকেও ডাকে পাক সেনা বাহিনীর বউ বলে।
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার নগরপাড় গ্রামের মনিন্দ্র চন্দ্র দাসের মেয়ে ,নরেন্দ্র চন্দ্র দে এর স্ত্রী এলাকার ব্যাপক আলোচিত বীরঙ্গনা বেলা রানী দাস। জানা যায় , ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন অপুর্ব সুন্দরী বেলা রানী দাসের বয়স মাত্র ১৫ বছর। নরেন্দ্র চন্দ্রর নব বিবাহিতা স্ত্রী বেলা রানী দাসকে স্থানীয় কুখ্যাত রাজাকার মোবারক , মুরতোজ , চাঁন মিয়া , ফরিদ গংদের সহযোগিতায় পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জাকের হোসাইন সহ একদল পাক সৈন্য ঘর থেকে ধরে নিয়ে যেতে আসলে স্বামী নরেন্দ্র বাধা প্রদান করায় ওই মুহর্তেই পাক হানাদাররা তাকে গুলি করে হত্যার পর স্ত্রী বেলা রানী দাসকে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে যুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময় তাকে আটক রেখে অমানবিক নির্যাতন করেন। অপুর্ব সুন্দরী হওয়ায় স্থানীয় রাজাকার ও পাক সেনাদের কুদৃষ্টি পরার কারনে তাকে এধরনের খেসারত দিতে হয়েছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তার চোখের সামনে অনেক বীরঙ্গনাকে প্রানে মেরে ফেললেও সুকৌশলে সে প্রানে বেচে যায় , কিন্তু বেলা রানী আক্ষেপ করে বলেন , বেচে যাওয়াটাই তার জীবনের সব চেয়ে বড় অভিশাপ , কারন এ সমাজ তাকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেনি। চরম বৈষম্যের ফলে ওই বীরঙ্গনা বাকি জীবনে আর বিয়ে সাদী করতে পারেনি। বেলা রানী ও তার ছোট ভাই প্রদীপ চন্দ্র দাসের শেষ সম্বল পৈত্রিক ভিটে মাটি কয়েক শতাংশ জায়গা বিভিন্ন কৌশলে বেদখলের জন্য ব্যাপক পায়তারা চালিয়ে ইতিমধ্যে তাদের বাড়ির সামনের অংশে বাওন্ডারী দেয়াল নির্মান করে কুচক্রিরা তাদেরকে অনেকটাই অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। অবৈধ দখলদারদের কালো থাবার কারনে সে এখন তার নিজ গৃহে গৃহ বন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
লক্ষ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময় আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এখানে কেবল মাত্র তিনজনের কাহিনী দিয়েছি কিন্তু এমন আরও লক্ষ বীরঙ্গনা রয়েছেন আজো এই বাংলাদেশের মাটিতে একটু সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার করুন আকুতি নিয়ে। আজ এ স্বাধীন দেশ আমরা কতটুকু দিতে পেয়েছি সেইসব বেঁচে থাকা বীরঙ্গনাদের ?
সংগ্রহেঃ Some where blog
হে বীরাঙ্গনা ! সালাম তোমাদের ! এবং আমাদের পাপমোচন
® এ আর মুকুল ।। নির্বাক গণতন্ত্র , স্বাধীনতা ডেস্ক© ।।©
আমি আঁধারে তামাসায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূন্যতা থেকে শূন্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে। একটি বিশেষ হারানো বিজ্ঞপ্তিঃ বাংলাদেশের বীরঙ্গনা মায়েরা হারিয়ে গেছেন। তাঁদের অনুসন্ধান চলছে। যদি সত্যিকারের কোন দেশপ্রেমিক সেই সব মায়েদের সন্তান থেকে থাকেন তবে তাঁদের বীরঙ্গনা মায়েদের সন্ধান দেয়ার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। আমাদের একাত্তুরের বীর-বীরঙ্গনা পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামটি লিখে দিয়ে আমাদের দিয়েগেছেন আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদার নিশ্চয়তা । তাঁরা আমাদের স্বাধীনতার বীর সৈনিক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীর সময় অনেক মা / বোন পাকিস্তানী হায়নাদের জুলুম নির্যাতনে তাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। লক্ষ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময় আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।লক্ষ বীরঙ্গনা রয়েছেন আজো এই বাংলাদেশের মাটিতে একটু সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার করুন আকুতি নিয়ে। আজ এ স্বাধীন দেশ আমরা কতটুকু দিতে পেয়েছি সেইসব বেঁচে থাকা বীরঙ্গনাদের? দেখতে পুতুলের মতই ছিলো ১০/১১ বছর বয়সেই পুরো ৯ মাস পাকিস্তানীদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাকে। এমন কোন রাত নেই যে বর্বর পশুগুলো তাকে ভোগ করেনি। সেদিনের সেই বিভীষিকাময় ১৯৭১ এর মার্চের শেষের দিকে শহরের এক পাকিস্তানী সেনাদের দোসর তাকে বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে যায় রেলষ্টেশনে পূর্ব পার্শ্বে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি দ্বিতল ভবনে। সেখানে নিয়ে অবস্থানরত পাকিস্তানী হায়েনাদের হাতে তুলে দিয়ে বাহাবা নিয়ে সটকে পরে রাজাকার। প্রথম দিনে ৯ জন হায়েনা পশুর মত ঝাপিয়ে পরে পুতুলের উপর। সারা রাত ধরে সম্ভ্রম হানি করে। অল্প বয়েসে পাশাবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেয়ে এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফিরে পুতুল দেখে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর প্রতিদিন রাতেই ভোগ্যপণ্যের মত পুতুলকে ভোগ করেছে খান সেনারা। সম্ভ্রম হানি শেষ হলে হাফফ্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরিয়ে হাত পায়ে শিকল বেঁধে তাকে তালাবন্ধ করে রাখা হতো বড় একটি কাঠের আলমারীতে।
[caption id="" align="alignnone" width="497"] লজ্জায় মুখ ঢেকে আছেন একজন বীরাঙ্গনা। আসলেতো লজ্জিত হওয়ার কথা আমাদের।[/caption]
গভীর রাতে তাকে নিয়ে যাওয়া হতো বন্ধভূমিতে। সেনারা হত্যাযঞ্জ চালার পর গাড়ীতেই পুতুলকে নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠত। এক সাগর রক্তের বিনিময় দেশ স্বাধীন হয়েছে। ডানহাতে বেয়নেটের আঘাত সহ শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন আর মানষিক যন্ত্রনা নিয়ে আজও বেঁচে আছেন একজন বীরঙ্গনা নারী পুতুল। শহরে রেলষ্টেশন সংলগ্ন একটি বস্তিতে কোন রকমে মাথা গুজার ঠাই হয়েছে এই বীরঙ্গনার। আমাদের শরীরের চামড়া দিয়ে যদি জুতা বানিয়ে তাঁদের পায়ে পরতে দেয়া যায় তবু তাঁদের ঋণ শোধ হবার নয়। তবু যদি তাঁদের জন্য কিছু করে যেতে পারি তবে নিজের আত্মার কাছে পরিতৃপ্তি নিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে চিরতরে ঘুমাতে পারব এই আশা নিয়ে স্বপ্ন দেখছি। কথায় কথায় আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্ব বোধ করি। মুক্তিযুদ্ধের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মান জানাই । আজ বেয়াল্লিশ বছর পরেও অবহেলিত থেকে গেলেন আমাদের বীরঙ্গনা মায়েরা। আমরা কি তাঁদের চোখের পানিটুকু মুছে দেয়ার মত মন নিয়ে এগিয়ে আসতে পারিনা ? এর জন্য দরকার হবে না কোন সংগ্রাম কিংবা অনশন শুধু দরকার আমাদের ভেতরকার মানুষটির জাগরন। আসুন আমরা এবার সত্যি জেগে উঠি, আমাদের মায়েদের চোখের পানি মুছে দেয়ার জন্য সবাই আবার একাত্ম হয়ে ৭১ এর দীক্ষায় শপথ নেই ।
বিশ্বের ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে দেখা যায় যেকোন জাতিকে দমন করার জন্য, নির্মূল করা জন্য দুটি অস্ত্র এক সাথে ব্যবহার করা হয়েছে; গণহত্যা এবং অপরটি ধর্ষন।
১৯৭১ সালে পাকি বাহিনী তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সাহায্যে ঠিক এই কাজটাই করেছিল বাংলাদেশে।
একাত্তুরে এদেশের নারীদের উপর যৌন নির্যাতননের ব্যপকতা, নৃশংসতা এ যাবতকালে বিশ্বে সংগঠিত সকল যৌন নির্যাতনের শীর্ষে। এই নির্যাতন ছিল সুপরিকল্পিত, তারা বাঙ্গালীদের ধর্ষনের মাধ্যমে এক নতুন জাতির সৃষ্টি করতে চেয়েছিল যাতে বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদ আর কোনদিন মাথা তুলে না দাড়াতে পারে। সম্প্রতি জেনারেল খাদিম হুসাইন (২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনাকারী) ১৯৭১ সাল নিয়ে এক আত্মকথনে লিখেছেন .......
"১০ এপ্রিল একটি সভায় জেনারেল নিয়াজি উপস্থিত। সেখানে তিনি অকথ্য ভাষায় বাঙালিদের গালিগালাজ করতে লাগলেন এবং এক পর্যায়ে উর্দুতে বললেন, 'ম্যায় ইস হারামজাদি কওম কি নাসাল বদল দুন গা। ইয়ে মুঝে কীয়া সামাঝতি হ্যায়'(আমি এই হারামজাদা জাতির চেহারা বদলে দেবো, এরা আমাকে কি মনে করে)"
নিয়াজির এই উক্তিতে উৎসাহিত হয়ে পাকিস্তান আর্মি বাঙালিদের ;চেহারা বদলের' সুযোগ লুফে নেয়। আর এর জন্য সহজ রাস্তা ছিল বাঙালি মেয়েদেরকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে।
যুদ্ধকালীন সময়ে সারা দেশের ৪৮০ টি থানা থেকে গড়ে প্রতিদিন ২ জন করে নির্যাতিত মহিলার সংখ্যা অনুসারে ২৭০ দিনে ধর্ষিতার নারীদের সংখ্যা দাড়ায় ২ লক্ষ। আন্তর্জাতিক প্লানড ফাদারহুড প্রতিষ্ঠানের ড. জিওফ্রে ডেভিস,যুদ্ধের পরপরই তিনি এসব মা ও তাদের শিশুদের সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন তাঁর মতে এই সংখ্যা আরও বেশি এবং সেটা ৪ লক্ষ। পাকি ক্যাম্প গুলোতে আটক নারীদের উপর অত্যাচারের যে বিবরন প্রতক্ষদর্শীগন দিয়েছেন তা এতই অবিশ্বাস্য রকমের নির্মম যে সেটা কোন মানুষ মানুষের সাথে করতে পারে বলে মনে হয় না........
'পাশবিক ধর্ষন শেষে এই নির্যাতিতা মেয়েদের হেড কোয়াটারের উপরের তলার বারান্দায় মোটা লোহার তারের সাথে চুল বেধে উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে রাখা হতো, সেখানে চলতো সীমাহীন বর্বরতা।
বিরামহীন প্রহার আর অত্যাচারে মেয়েদের দেহের মাংস কেটে রক্ত ঝরছিল, কারো মুখের সামনের দিকে দাঁত ছিল না, ঠোটের দু'দিকের মাংস কামড়ে, টেনে ছিড়ে ফেলা হয়েছিল, লাঠি ও রডের আঘাতে হাতের আঙ্গুল, তালু ছিল থেতলানো। প্রসাব পায়খানার জন্যও তাদের হাত ও চুলের বাধন এক মুহূর্তের জন্য খুলে দেয়া হতো না। হেডকোয়াটারের বারান্দায় লোহার রডে ঝুলন্ত অবস্থায় তারা প্রসাব পায়খানা করতো।
অত্যাচারে কেউ মরে গেলে তখন অন্য মেয়েদের সামনে ছুরি দিয়ে দেহ কেটে কুচি কুচি করে বস্তায় ভরে ফেলে দেয়া হতো"
"অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তারা যখন একটু পানি চাইতো তখন হানাদার ও তাদের সহযোগীরা ডাবের খোসায় প্রসাব করে সেটা খেতে দিত"
"তাদের পরবার জন্য কোন শাড়ি দেয়া হতো না (যদি শাড়ি পেচিয়ে আত্মহত্যা করে তাই), দিনের বেলায় একটা তোয়ালে আর রাতে দেয়া হতো কম্বল! গোসলের প্রয়োজন হলে তিন জন করে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেয়া হতো, রাজাকার ও পাকিরা দড়ির এক প্রান্ত ধরে রেখে তাদের নিয়ে যেতে গোসলে'..... (বাংলাদেশের স্বাধীনতার দলীলপত্র, ৮ম খন্ড, হাসান হাফিজুর রহমান )।
১৯৭১ পাকি বাহিনী তাদের দোস্ত রাজাকার ও দালালদের প্রতক্ষ্য সহযোগীতায় আট মাসে রক্ষনশীল হিসাবে বাংলাদেশে ৪ লক্ষেরও বেশি নারী ধর্ষন ও নির্যাতন করেছিল. বিশ্বের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটেনি। ছয় বছর ব্যাপী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে 'গোটা ইউরোপে' নাৎসি ও ফ্যাস্টিট বাহিনী সম্মিলিতভাবে এত বেশি নারীকে ধর্ষন, নির্যাতন করেনি' (ড:এম এ হাসান, ২০০২, পৃ-৫)।
যুদ্ধ যখন চলছিল তখন বেঁচে থাকাটাই ছিল মৌলিক বিষয়, সুতরাং এই বিষয়টা তখন সেই সময়ে মুখ্য হয়ে দেখা দেয়নি আর মানুষ বুঝতেও পারেনি এই ভয়াবহ জাতি ভিত্তিক ধর্ষনের বিষয়টা। কিন্তু যুদ্ধোত্তর কালে যখন একজন দু'জন করে ঘরে ফিরতে শুরু করলো তখন সৃষ্টি হলো এক এক সামাজিক ও মানসিক সংকটের। কারণ এই চার লক্ষ ধর্ষিতা নারী শুধু নয়, তাদের সাথে সম্পর্কিত চার লক্ষ পরিবার, সকল পরিবারই তাদের কে উদার চিত্তে গ্রহণ করেনি, অনেক নারী পরিত্যাজ্য হয়েছিলেন, অনেকে আত্নহত্যা করেছেন, রোগাক্রান্ত হয়ে ধুকে ধুকে মরে গেছেনে অনেকেই। সেই সাথে দেখা দিয়েছিল নারীদের দীর্ঘমেয়াদি শাররীক অসুস্থ্যতা, এই বিষয়ে ড: ডেভিস বলেছেন....
"৯ মাসে পাক বাহিনীদের দ্বারা ধর্ষিতা চার লাক্ষ মহিলার বেশির ভাগ মহিলাই সিফিলিস বা গনোরিয়া কিংবা উভয় রোগেরই শিকার হয়েছেন, এদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে ভ্রুন হত্যাজনিত অভিগতা লাভ করেছেন। তিনি বলেন এরা বন্ধ্যা হয়ে যেতে পারেন কিংবা জীবনভর বারবার রোগে ভুগতে পারেন।"
১৯৭১ এর ২৫শে মার্চের পর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্থানি হায়েনাদের গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের নারকীয় দৃশ্যাবলী প্রত্যক্ষ করেছেন সেখানকার সুইপার রাবেয়া খাতুন। পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তার একটি প্রামাণ্য দলিল রাবেয়া খাতুনের এ জবানবন্দি, যা নেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশের স্বাধীণতা যুদ্ধ ও দলিলপত্র: অষ্টম খন্ড’ থেকে। তিনি এই জবানবন্দি দিয়েছেন ১৯৭৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী তারিখে। তার সেই জবানবন্দি কোন রকম বিকৃত করা ছাড়াই নিচে দেওয়া হলো:
১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার পাঞ্জাবী সেনারা যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উপর অতর্কিতে হামলা চালায় তখন আমি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এস.এফ. ক্যান্টিনে ছিলাম। আসন্ন হামলার ভয়ে আমি সারাদিন পুলিশ লাইনের ব্যারাক ঝাড়ু দিয়ে রাতে ব্যারাকেই ছিলাম। কামান, গোলা, লাইট বোম আর ট্যাঙ্কারের অবিরাম কানফাটা গর্জনে আমি ভয়ে ব্যারাকের মধ্যে কাত হয়ে পড়ে থেকে থর থরিয়ে কাঁপছিলাম। ২৬ মার্চ সকালে ওদের কামানের সম্মুখে আমাদের বীর বাঙালি পুলিশ বাহিনী বীরের মতো প্রতিরোধ করতে করতে আর টিকে থাকতে পারেনি। সকালে ওরা পুলিশ লাইনের এস.এফ. ব্যারাকের চারিদিকে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং ব্যারাকের মধ্যে প্রবেশ করে। বাঙালি পুলিশের নাকে মুখে সারা দেহে বেয়নেট বেটন চার্জ করতে করতে বুটের লাথি মারতে মারতে বের করে নিয়ে আসছিল।
ক্যান্টিনের কামরা থেকে বন্দুকের নলের মুখে আমাকেও বের করে আনা হয়। আমাকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়া হয় এবং আমার উপর প্রকাশ্যে পাশবিক অত্যাচার করছিল আর কুকুরের মতো অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ছিল। আমার উপর উপর্যুপরি অত্যাচার করতে করতে যখন আমাকে একেবারে মেরে ফেলার উপক্রম হয় তখন আমার বাঁচার আর কোনো উপায় না দেখে আমি আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্য ওদের নিকট কাকুতি মিনতি জানাচ্ছিলাম। আমি হাউমাউ করে কাঁদছিলাম, আর বলছিলাম আমাকে মেরো না, আমি সুইপার, আমাকে মেরে ফেললে তোমাদের পায়খানা ও নর্দমা পরিষ্কার করার কেউ থাকবে না, তোমাদের পায়ে পড়ি তোমরা আমাকে মেরো না, মেরো না, মেরো না! আমাকে মেরে ফেললে তোমাদের পুলিশ লাইন রক্ত ও লাশের পঁচা গন্ধে মানুষের বাস করার অযোগ্য হয়ে পড়বে।
তখনো আমার উপর এক পাঞ্জাবী কুকুর, কুকুরের মতোই আমার কোমরের উপর চড়াও হয়ে আমাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করছিল। আমাকে এভাবে ধর্ষণ করতে করতে মেরে ফেলে দিলে রাজারবাগ পুলিশ লাইন পরিষ্কার করার জন্য আর কেউ থাকবে না একথা ভেবে আমাকে এক পাঞ্জাবী সেনা ধমক দিয়ে বলতে থাকে, ঠিক হায়, তোমকো ছোড় দিয়া যায়েগা জারা বাদ, তোম বাহার নাহি নেকলেগা, হার ওয়াকত লাইন পার হাজির রাহেগা। একথা বলে আমাকে ছেড়ে দেয়।
পাঞ্জাবী সেনারা রাজাকার ও দালালদের সাহায্যে রাজধানীর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা এবং অভিজাত জনপদ থেকে বহু বাঙালি যুবতী মেয়ে, রূপসী মহিলা এবং সুন্দরী বালিকাদের জিপে, মিলিটারি ট্রাকে করে পুলিশ লাইনের বিভিন্ন ব্যারাকে জামায়েত করতে থাকে। আমি ক্যান্টিনের ড্রেন পরিষ্কার করছিলাম, দেখলাম আমার সম্মুখ দিয়ে জিপ থেকে আর্মি ট্রাক থেকে লাইন করে বহু বালিকা, যুবতী ও মহিলাকে এস.এফ. ক্যান্টিনের মধ্য দিয়ে ব্যারাকে রাখা হলো। বহু মেয়েকে হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং-এর উপর তলার রুমে নিয়ে যাওয়া হলো, আর অবশিষ্ট মেয়ে যাদেরকে ব্যারাকের ভেতরে জায়গা দেয়া গেলো না তাদের বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। অধিকাংশ মেয়ের হাতে বই ও খাতা দেখলাম, তাদের মধ্যে অধিকাংশ মেয়ের চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু পড়ছিলো।
এরপরই আরম্ভ হয়ে গেল সেই বাঙালি নারীদের উপর বীভৎস ধর্ষণ। লাইন থেকে পাঞ্জাবী সেনারা কুকুরের মতো জিভ চাটতে চাটতে ব্যারাকের মধ্যে উন্মক্ত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে প্রবেশ করতে লাগলো। ওরা ব্যারাকে প্রবেশ করে প্রতিটি যুবতী, মহিলা ও বালিকার পরনের কাপড় খুলে একেবারে উলঙ্গ করে মাটিতে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে বীভৎস ধর্ষণে লেগে গেল। কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সেই নিরীহ বালিকাদের উপর ধর্ষণে লেগে গেল। আমি ব্যারাকে ড্রেন পরিস্কার করায় অভিনয় করছিলাম আর ওদের বীভৎস পৈশাচিকতা দেখছিলাম। ওদের উন্মত্ত উল্লাসের সামনে কোনো মেয়ে কোনো শব্দ পর্যন্তও করে নাই, করতে পারে নাই। উন্মত্ত পাঞ্জাবী সেনারা এই নিরীহ বাঙালি মেয়েদের শুধুমাত্র ধর্ষণ করেই ছেড়ে দেয় নাই, আমি দেখলাম পাক সেনারা সেই মেয়েদের পাগলের মতো উঠে ধর্ষণ করছে আর ধারালো দাঁত বের করে বক্ষের স্তন ও গালের মাংস কামড়াতে কামড়াতে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। ওদের উদ্ধত ও উন্মত্ত কামড়ে অনেক কচি মেয়ের স্তনসহ বক্ষের মাংস উঠে আসছিল। মেয়েদের গাল, পেট , ঘাড়, বক্ষ, পিঠের ও কোমরের অংশ ওদের অবিরাম দংশনে রক্তাক্ত হয়ে গেল।
যে সকল বাঙালি যুবতী ওদের প্রমত্ত পাশবিকতার শিকার হতে অস্বীকার করল দেখলাম তৎৰণাৎ পাঞ্জাবী সেনারা ওদেরকে চুল ধরে টেনে এনে স্তন ছোঁ মেরে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ওদের যোনি ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে বন্দুকের নল, বেয়নেট ও ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে সেই বীরঙ্গনাদের পবিত্র দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। অনেক পশু ছোট ছোট বালিকাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে ওদের রক্তাক্ত দেহ বাইরে এনে দুজন দু'পা দু'দিকে টেনে ধরে চড় চড়িয়ে ছিড়ে ফেলে দিল, আমি দেখলাম সেখানে বসে বসে, আর ড্রেন পরিষ্কার করছিলাম। পাঞ্জাবীরা মদ খেয়ে খেয়ে কুকুরের মতো যার যে মেয়ে ইচ্ছা তাকেই ধরে ধর্ষণ করছিল।
শুধু সাধারণ পাঞ্জাবী সেনারাই এই বীভৎস পাশবিক অত্যাচারে যোগ দেয়নি। সকল উচ্চ পদস্থ পাঞ্জাবী সামরিক অফিসাররা মদ খেয়ে হিংস্র বাঘের মতো হয়ে দুই হাত বাঘের মত নাচাতে নাচাতে সেই উলঙ্গ বালিকা, যুবতী ও বাঙালি নারীদের ওপর সারাক্ষণ পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ কাজে লিপ্ত থাকতো। কোনো মেয়ে-নারী-যুবতীকে এক মুহূর্তের জন্য অবসর দেয়া হয়নি। হানাদারদের উপর্যুপরি ধর্ষণ ও অবিরাম অত্যাচারে বহু কচি বালিকা সেখানে রক্তাক্ত দেহে কাতরাতে কাতরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। পরের দিন এই সকল মেয়ের লাশ অন্য মেয়েদের সম্মুখে ছুরি দিয়ে কেটে কুচি কুচি করে বস্তার মধ্যে ভরে বাইরে ফেলে দিত। এ সকল নারী, বালিকা ও যুবতীর নির্মম পরিণতি দেখে অন্য মেয়েরা আরো ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো এবং স্বেচ্ছায় পশুদের ইচ্ছার সম্মুখে আত্মসমর্পণ করতো।
যে সকল মেয়েরা প্রাণের ভয়ে বাঁচার জন্য ওদের সঙ্গে মিল দিয়ে ওদের অতৃপ্ত যৌনক্ষুধা চরিতার্থ করার জন্য সর্বোতভাবে সহযোগিতা করে তাদের পেছনে ঘুরে বেরিয়েছে তাদের হাসি তামাশায় দেহ-মন দান করেছে তাদেরকেও ছাড়া হয় হয় নাই। পদস্থ সামরিক অফিসাররা সেই সকল মেয়েদের উপর সম্মিলিতভাবে ধর্ষণ করতে করতে হঠাৎ একদিন তাকে ধরে ছুরি দিয়ে তার স্তন কেটে পাছার মাংস কেটে, যোনি ও গুহ্যদারের মধ্যে সম্পূর্ণ ছুরি চালিয়ে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে তারা আনন্দ উপভোগ করতো।
এরপর উলঙ্গ মেয়েদেরকে গরুর মতো লাথি মারতে মারতে পিটাতে পিটাতে উপরে হেডকোয়ার্টারের দোতলা, তেতালা ও চার তলায় উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। পাঞ্জাবী সেনারা চলে যাবার সময় মেয়েদেরকে লাথি মেরে আবার কামরার ভেতরে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে চলে যেত। এরপর বহু যুবতী মেয়েকে হেডকোয়ার্টারের উপর তলার বারান্দায় মোটা লোহার তারের উপর চুলের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়। প্রতিদিন পাঞ্জাবীরা সেখানে যাতায়াত করতো। সেই ঝুলন্ত উলঙ্গ যুবতীদের কেউ এসে তাদের উলঙ্গ দেহের কোমরের মাংস বেটন দিয়ে উন্মক্তভাবে আঘাত করতে থাকতো, কেউ তাদের বক্ষের স্তন কেটে নিয়ে যেতো, কেউ হাসতে হাসতে তাদের যৌনপথে লাঠি ঢুকিয়ে আনন্দ উপভোগ করতো। কেউ ধারালো চাকু দিয়ে কোনো যুবতীর পাছার মাংস আস্তে আস্তে কেটে কেটে আনন্দ করতো। কেউ উঁচু চেয়ারে দাঁড়িয়ে উন্মুক্ত বক্ষ স্তন মুখ লাগিয়ে ধারাল দাঁত দিয়ে স্তনের মাংস তুলে নিয়ে আনন্দে অট্টহাসি করতো। কোনো মেয়ে এসব অত্যাচারে কোনো প্রকার চিৎকার করার চেষ্টা করলে তার যৌনিপথ দিয়ে লোহার রড ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে তৎৰণাৎ হত্যা করা হতো। প্রতিটি মেয়ের হাত বাঁধা ছিল ও পেছন দিকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। অনেক সময় পাঞ্জাবী সেনারা সেখানে এসে সেই ঝুলন্ত উলঙ্গ মেয়েদের এলোপাতারি বেদম প্রহার করে যেতো।
প্রতিদিন এভাবে বিরামহীন প্রহারে মেয়েদের দেহের মাংস কেটে রক্ত ঝরছিলো, মেয়েদের কারো মুখের সম্মুখের দাঁত ছিলনা। ঠোঁটের দুদিকের মাংস কামড়ে টেনেছিড়ে ফেলা হয়েছিল। লাঠি ও লোহার রডের অবিরাম পিটুনিতে প্রতিটি মেয়ের আঙ্গুল হাতের তালু ভেঙ্গে থেতলে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এসব অত্যাচারিত ও লাঞ্ছিত নারী ও মেয়েদের প্রস্রাব ও পায়খানা করার জন্য হাতের ও চুলের বাঁধন এক মুহূর্তের জন্যও খুলতে দেয়া হতো না। হেডকোয়ার্টারের উপর তলায় বারান্দায় এই ঝুলন্ত মেয়েরা হাত বাধা অবস্থায় লোহার তারে ঝুলে থেকে সামনে পায়খানা-প্রস্রাব করতো। আমি প্রতিদিন গিয়ে এসব পায়খানা পরিষ্কার করতাম।
আমি স্বচক্ষে দেখেছি অনেক মেয়ে অবিরাম ধর্ষণের ফলে নির্মমভাবে ঝুলন্ত অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেছে। প্রতিদিন সকালে গিয়ে সেই বাধন থেকে অনেক বাঙালি যুবতীর বীভৎস মৃতদেহ পাঞ্জাবী সেনাদের নামাতে দেখেছি। আমি দিনের বেলায়ও সেখানে সব বন্দি নারীদের পূত গন্ধ প্রশ্রাব পায়খানা পরিষ্কার করার জন্য সারাদিন উপস্থিত থাকতাম। প্রতিদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ব্যারাক থেকে এবং হেডকোয়ার্টারের অফিসের উপর তলা হতে বহু ধর্ষিতা মেয়ের ক্ষতবিক্ষত বিকৃত লাশ ওরা পায়ে রশি বেঁধে টেনে নিয়ে যেত এবং সেই জায়গায় রাজধানী থেকে ধরে আনা নতুন নতুন মেয়েদের চুলের সঙ্গে ঝুলিয়ে বেঁধে নির্মমভাবে ধর্ষণ আরম্ভ করে দেয়। এসব উলঙ্গ নিরীহ বাঙালি যুবতীদের সারাক্ষণ সশস্ত্র পাঞ্জাবী সেনারা প্রহরা দিত। কোনো বাঙালিকেই সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হতো না। মেয়েদের হাজার কাতর আহাজারিতেও আমি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাঙালি মেয়েদের বাঁচাবার জন্য কোনো ভূমিকা পালন করতে পারি নাই। এপ্রিল মাসের দিকে আমি অন্ধকার পরিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে খুব ভোরে হের্ডকোয়ার্টারের উপর তলায় সারারাত ঝুলন্ত মেয়েদের মলমূত্র পরিষ্কার করছিলাম। এমন সময় সিদ্ধেশ্বরীর ১৩৯ নং বাসার রানু নামে এক কলেজের ছাত্রীর কাতর প্রর্থনায় আমি অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়ি এবং মেথরের কাপড় পরিয়ে কলেজ ছাত্রী রানুকে মুক্ত করে পুলিশ লাইনের বাইরে নিরাপদে দিয়ে আসি। স্বাধীণ হওয়ার পর সেই মেয়েকে আর দেখি নাই ।
রারেয়া খাতুনের জবানবন্দিতে যে লোমহর্ষক কাহিনী বর্ণনা পাওয়া যায়, সে কাহিনী সেই সময়ে বা এ যাবৎ বাংলাদেশের কতজন জানে? আর যদি নাই জানে তাহলে কেন জানে না? পৃথিবীর কোথাও এমন ঘৃণ্যতম ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছেন কি? কেন আমাদের সামনে এসব ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি? কেন তরুণ প্রজন্মের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লুকোচুরি চলে ?
যুদ্ধ শিশুঃ যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে সেই সময়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছিলেন ড: নীলিমা ইব্রাহীম। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে বঙ্গবন্ধু বলেন....
"না আপা। আপনি দয়া করে পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের বাইরে (বিদেশে) পাঠিয়ে দেন। তাদের সম্মনের সঙ্গে মানুষের মতো বড় হতে দিতে হবে। তাছাড়া আমি এসব নষ্ট রক্ত দেশে রাখতে চাই না’। (ইব্রাহিম, ১৯৯৮ : ১৮)"
বিদেশী নাগরিকরা যাতে সহজেই যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নিতে পারেন সে জন্য ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে প্রজ্ঞাপিত হয় The Bangladesh Abandoned Children (Special Provisions) Order। এরই ধারাবাহিকতায় আই এস এস, বাংলাদেশ সেন্ট্রাল অর্গানাইজেশন ফর রিহ্যাবিলিশনের সাহায্যে যুদ্ধ শিশুরা আশ্রয় পেতে থাকে বিদেশী বাবা-মায়েদের কাছে। সর্ব প্রথম যে দেশটি এগিয়ে এসেছিল আমাদের বাচ্চাদের আশ্রয় দিতে সেই দেশ কানাডা(মুনতাসির মামুন, ২০১৩, পৃ-৪৮,৪৯)।
১৯৭২ সালে ১৯ জুলাই বাংলাদেশ থেকে ১৫ জন যুদ্ধ শিশু প্রথম কানাডার আশে- সেই সময়ে বিদেশী পত্রপত্রিকা গুলোতে এই বিষয়টা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল, তারা স্বাগত জানিয়েছিল এই উদ্যোগের। কলকাতার মাদার তেরেসা যুদ্ধ শিশুদের গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন এছাড়াও যে সব এগিয়ে এসেছিল যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নিতে তার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, সুইডেন এবং অষ্ট্রেলিয়া ।
এই দেশের রক্তাক্ত জন্ম প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ তারাও, এই দেশের প্রতিটি মাটির কণায়, বাতাসে, এই পতাকায় তারও অধিকার ছিল, সেই অধিকার কি কেড়ে নেয়া হয়নিব? কি অপরাধে ?এই অসহায় শিশুদের সম্পূর্ন ইতিহাস কোনদিন জানা যাবে না। তাদের বীরাঙ্গনা উপাধি প্রাপ্ত মায়েদের মতো তারাও তারা হারিয়ে গেছে, কেউ মনে রাখেনি তাদের ।
বীরাঙ্গনা নামকরন সম্পর্কে সুলতানা কামাল বলেছিলেন.......
"স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সমস্ত নারীর ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল, যাদের ধর্ষন করা হয়েছিল, তাদের প্রতি সেই সময়ের যে নির্যাতন করা হয়েছিল, তাদের প্রতি সহানুভূতি এবং তাদের রক্ষা করতে না পারা ছিল জাতির জন্য এক অসহায় লজ্জা। অত্যন্ত অবেগআপ্লুত মনোভাব থেকে তাদের নাম দেয়া হয় বীরাঙ্গনা'।
তবে আমরা আজ যা দেখছি, বাস্তবতা খুবই কঠিন। একটা সময় থেকে শুধু ধর্ষিতাদেরই বীরাঙ্গনা হিসাবে বোঝানো হয়েছে এবং হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে অন্তর্জাল রবাবরই সোচ্চার ছিল, ইদানিং একটু বেশি। ভাল লাগে দেখতে তবে খুব কষ্ট পাই যখন দেখি গালি হিসেবে বলা হচ্ছে ' তুই পাকি বাবাদের রেখে যাওয়া বীর্য' কিংবা 'কয়জন পাকি মিলে তোরে বানাইছে' কিংবা 'চাঁদের বুড়ি এখন বীরাঙ্গনা' নামের কার্টুন, বিরোধী দলীয় নেতাকে "বীরাঙ্গনা" বলে উপহাস সুচক রসালো আলোচনা........ এসব দেখে মনে হয় আমাদের এই প্রজন্ম আমাদের অনেক আবেগ আছে ঠিকই কিন্তু আমরা কি আসলেই 'বীরাঙ্গনা' 'যুদ্ধ শিশু' বিষয় গুলোর সম্পর্কে ঠিক ভাবে জানি, ঠিক ভাবে হৃদয়ে ধারণ করি?
আমরা কি জানি এই দুই বিশেষণের পেছনে কত বেদনা, অশ্রু, ত্যাগ আছে?
একটু ভেবে দেখবেন কি ??
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সুজান ব্রাউনমিলারের গ্রন্থ Against Our Will: Men, Women and Rape থেকে অনুবাদঃ
Brownmiller লিখেছিলেন, একাত্তরের ধর্ষণ নিছক সৌন্দর্যবোধে প্রলুব্ধ হওয়া কোন ঘটনা ছিলনা আদতে; আট বছরের বালিকা থেকে শুরু করে পঁচাত্তর বছরের নানী-দাদীর বয়সী বৃদ্ধাও স্বীকার হয়েছিল এই লোলুপতার। পাকসেনারা ঘটনাস্থলেই তাদের পৈচাশিকতা দেখিয়েই ক্ষান্ত হয়নি ; প্রতি একশ জনের মধ্যে অন্তত দশ জনকে তাদের ক্যাম্প বা ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হতো সৈন্যদের জন্য। রাতে চলতো আরেক দফা নারকীয়তা । কেউ কেউ হয়ত আশিবারেও বেশী সংখ্যক ধর্ষিত হয়েছে ! এই পাশবিক নির্যাতনে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, আর কতজনকে মেরে ফেলা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা হয়ত কল্পনাও করা যাবে না । (Brownmiller, p. 83)
বাংলাদেশে নারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা সম্পর্কে ওয়ার্ল্ড ক্রাইমস ফ্যাক্টরস এ্যান্ড ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান বলেন,সার্বিক অর্থে এ দেমে নারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। পুরুষ তো শুধু যুদ্ধ করেছে, নারী যুদ্ধ তো করেছেই, তার সঙ্গে যুদ্ধের আনুষাঙ্গিক অনেক কাজ করেছে। যে কাজগুলো নারী না করলে মুক্তিযুদ্ধ সফল হতো না। তাই সার্টিফিকেটের নাম দেখে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নারীকে মূল্যায়ণ করা হলে তা হবে মস্ত বড় ভুল।
বীরাঙ্গনা নারীর কথাঃ সরকারি হিসেবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছে। গবেষকের মতে, এ সংখ্যা চার লাখ। ওয়ার এসন্ড ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইনডিংস কমিটির পুরোধা এম এ হাসান জানান, ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা ৮৮ হাজার ২শ বীরা হন। অর্থ বীর নারী। সে অর্থকে ভিত্তি করে স্বাধীনতার পর পাকবাহিনী ও তার দোসরদের হাতে লাঞ্চিত নারীদের বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছিলেন বীরঙ্গনা। কিন্তু এ সমাজ তা মেনে নেয়নি। মেনে নেয়নি বলেই দু’লাখ ধর্ষিতা নারী। বীরাঙ্গনা নামেই সমাজের কাছে হয়েছে নিগৃহীত, —-এক ঘরে। এতদিন পরও তাকে শুনহে হয়, তোকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তুই তো বেশ্যা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার হাশিমপুর গ্রামের মাসুদা খাতুন, এলজাম নেছা ও দুলজাম নেছা তিন জনই একাত্তুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে গিয়ে হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন। পাকসেনারা ক্যাম্পে আটকে রেখে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। তারা এ প্রতিবেদককে জানান, এখনও স্বাধীনতার এত বছর পরও ‘নষ্টা’ নাম দিয়ে তাদের এক ঘরে করে রাখা হয়েছে।তাদের সাধারণ টিউবওয়েল থেকে পানি নিতেও বাধা দেওয়া হয়। তিন বীরাঙ্গনাকেই তাদের ছেলে মেয়ের বিয়ে দিতে বেগ পেতে হয়। বারবার বিয়ে ভেঙ্গে যায়। শেষ মেষ মুক্তিযুদ্ধের ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় কুষ্টিয়া মহিরা ক্লাব। সংগঠনটি তাদের মানসিক সহযোগিতা ছাড়াও হাতে তুলে দেয় সেলাই মেশিন। চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ তিনজনের কেউই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাননি ।
মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাসের মধ্যে ছয় মাসই তাকে রক্তমাখা শাড়ি ও ব্লাউজ পড়ে কাটাতে হয়। ‘৭১ সালের এপ্রিলে যশোর জেলার ইদ্রা গ্রামে হালিমা পারভীনদের বাড়িতে হামলা চালায় রাজাকারও হানাদার বাহিনী। বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এরপরই হালিমা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধরত অবস্থায় তিনি জুনে ধরা পড়েন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। শুরু হয় অকল্পনীয় যন্ত্রনার জীবন। প্রথমে তাকে রাখা হয় রাজাকারদের ক্যাম্পে প্রতিদিন তাকে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচানো হতো। কিছু দিনপর তাকে চোখ বেধে নিয়ে যাওয়া হয় যশোর ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে একদিন পর একদিন তাকে খেতে দেওয়া হতো। তাকেই কবর খুড়তে হতো, সেসব মেয়েদের যারা হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে মরে যেত। অথবা গণ ধর্ষনের পর হত্যা করা হতো। তিনি এসবও জানান, ‘৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা হালিমাকে উদ্ধার করে তার বাবার বাড়ি পৌছে দেয়। কিন্তু তারপর হালিমার জীভনে নেমে আসে অন্য রকমের বিড়ম্বনা। জীবিত ও সাধারণ ক্ষমা পাওয়া রাজাকাররা তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা চারায়। একদিন রাতে হালিমা পালিয়ে আসেন তার চাচার কাছে। চাচা উদ্যোগ নেন তাকে বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু হানাদার বাহিনীর হাতে বন্ধি থাকার কথা জানাজানি হলে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। ‘৮৩ সালে তিনি আয়ার চাকরি পান মহেশপুর হাসপাতালে। ‘৮৪ সালে তার বিয়ে হয় মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে। শশুর তাদের ত্যাজ করেন। সংসার জীবনেও তার হালিমার কাটেনি। দুছেলে মেয়ের মধ্যে এক ছেলে অন্ধ। আমিও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গেজেটে (নং-২০৮৩) হালিমার নাম রয়েছে তবু টাকার অভাবে তার চিকিৎসা হচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধা নারীর অবদানকে যথাযথ মর্যাদা না দেওয়ার প্রসঙ্গে কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, নারীর সাহস পুরুষের আড়ালে হারিয়ে যায়। নারী কোন সাহসের কাজ করলে বলা হয় পুরুষোচিত সাহস। তাই মুক্তিযোদ্ধা নারীর অবস্থা এখনও উপেক্ষিত।
মুক্তিযুদ্ধের দলিলে ও বিভিন্ন পুরুষ গ্রন্থাকারের রচনায় নারী স্বীকৃতি না পেলেও এটা ঐতিহাসিক সত্য নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় অসম সাহসের পরিচয় দিয়েছে গ্রামর একজন সামান্য নারী দেশের জন্য নিজের জীবনকে বাজি রেখেই যুদ্ধে নেমেছে। শুধু সামনা সামনি যুদ্ধ করা নয়, নারী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, তাদের জন্য ক্যাম্পে ক্যাম্পে, গিয়ে রান্না করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার পৌছে দিয়েছে। করেছে গুপ্তচর বৃত্তির কাজ। সেই সঙ্গে নিজের ঘর সামলেছে। সিরাজগঞ্জের মনিকা মতিন সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। তিনি নারী যোদ্ধাদের স্মরণ করে বলেন, আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় শতকরা ৯৮ ভাগ নারীই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। এদেশে কোন নারী রাজাকার নেই। আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় যমুনার এপার ওপার যুদ্ধ করেছি। এ দুঅংশে পাক বাহিনীর যাওয়া আসা খুব কষ্টকর ছিল। রাজাকাররাও যাওয়া আসা করতে ভয় পেত। নারী এ সুযোগটি নিয়ে দিব্য আসা যাওয়া করে খবর আনা নেওয়া করতো। মনিকা এ প্রতিবেদককে আরও বলেন, আমি যদিও বন্ধুক চালাতে পারতাম না, তবু রাতে পাহাড়া দেবার জন্য দাঁড়াতাম। শত্রুর আনাগোনার খবর পেলে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতাম। সাংবাদিক বেবী মওদুদ জানান, তারা মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের লোকদের খাবার সরবরাহ করতেন। এ কাজে সাহায্য করতেন কবি সুফিয়া কামাল। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ধানম-ির অনেকেই ঢাকা ছাড়ার আগে তাদের রেশম কার্ড সুফিয়া কামালকে দিয়ে যেতেন। তিনি সে কার্ড দিয়ে তেল, আটা, চাল তুলে রাখতেন। পরে তা বিতরণ করা হতো। অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ রিকশাওয়ালা সেজে তা বাড়ি বাড়ি পৌছে দিতেন। মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর হেমায়েত বাহিনীতে ছিলেন ২৪ জন মহিলা। এরা অস্ত্র চালানো জানতেন। এর ফলে ছিলেন কবি আজমেরী ওয়ারেস। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, তিনি একবার সন্ত্রাস সম্ভবা সজে পেটে অস্ত্র নিয়ে সাভার থেকে ঢাকা আসেন। ’৭১ এ ফাতেমার বয়স ছিল ১৩ বছর। চুল ছোট থাকায় ছেলের মতো মনে হতো। ফাতেমা কাদের মিয়া বাহিনীর প্রধান ক্যাম্প উপজেলার বাহড়াতৈলে মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করতেন, গোলাবারুদ পাহাড়া দিতেন, খবর আনা নেওয়া ও অস্ত্র সরবরাহ করতেন। ফাতেমা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেতেন। সাড়ে ৫ বছর যাবত তা বন্ধ রয়েছে। ফাতেমা বর্তমানে অনিয়মিতভাবে সখীপুর পৌরসভায় ঝাড়–দার পতে কাজ করছেন। স্বামী মোবারক আলী সুইপার। চার ছেলে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। নারী নেত্রী মালেকা বেগম নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে বলেন, নারীকে কেউ সহজে সংগ্রামের পথে নেয়নি। প্রীতিলতা ওয়েদার যখন শীহদ হন, তখন তার একটি চিঠিতে জানা যায়, তিনি লিখেছেন, নারীকে কেউ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করতে দেয়নি। বহু বাঁধা ছিল এমনি নারীর যে যন্ত্রণা তা মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্ট ও যন্ত্রণার চেয়ে কম নয়। তবু নারী থেমে নেই।
এক পরিবারের তিনবোন আসমা, রেশমা ও সায়মা খান। ঢাকায় তাদের বাড়িতে জমা রাখতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ। পরে তা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করতেন। ’৭১ এ আসমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএসসি পড়তেন। সায়মা ও রেশমা কলেজে পড়তো। নারী গ্রন্থ প্রবর্তসর এক সংবর্ধনা সভায় সায়মা জানান, মুক্তিযোদ্ধারা ঠিক করলেন ’৭১ এর ১৪ আগস্ট ঢাকার কয়েকটি এলাকায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করবেন। আমাদের পতাকা তৈরির দায়িত্ব দিলেন। আমরা ২৮ দিনে ২০০টি পতাকা সেলাই করি। যদি কেউ সন্দেহ করে, তাই কাপড় কেনার সময় আমরা প্রথম সবুজ লুঙ্গি কিনি। তারপর কিনি লাল ও হলুদ কাপড়। পতাকা টানানো হল। ঘরে জমে ওঠনো সবুজ কাপড়ের টুকরো। আমার মা শঙ্কিত হলেন, যদি পাকবাহিনী বাড়ি সার্চ করে তবে তারা বুঝে যাবে। মা ক্রুসকাঁচা দিয়ে সবুজ কাপড়ে লেস করে তৈরি করেছেন টেবিল ম্যাট। তারপর উপহার দিলেন আত্মীয় স্বজনকে। ১৪ আগস্ট গাড়ি নিয়ে আমরা তিনবোন গ্যাস বেলুনের সাহায্যে আজিমপুর তোপখান ও স্টেডিয়ামে পতাকা ওড়াই। পতাকা দেখে পাকবাহিনী বেলুন লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে।
১৯৭৩ সালে ৬শ ৭৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন উপাদিতে ভূষিত করা হয়। তার মধ্যে নারী ছিলেন মাত্র দুজন। তারা হলেন, তারামন বিবি ও মেডিকেল কোরের চিকিৎসক সেতারা বেগম। দীর্ঘদিন তারামন বিবি বীর প্রতীক ছিলেন শুধুই সরকারী গেজেটে। স্বাধীনতার চব্বিশ বছর পরে তারামন বিবি জানতে পারেন তিনি বীর প্রতীক পদক পেয়েছেন। ততদিনে দারিদ্র তাকে কাবু করে ফেলেছে, যক্ষ্মা এসেছে বাঁসা বেধেছে বীর হৃদয়ে।
গীতা দাস তার মুক্তমনায় প্রকাশিত ‘তখন ও এখন’ ধারাবাহিকের ২৪তম পর্বে পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক নির্যাতিতা তার কিশোরী মাসী প্রমিলার করুন পরিণতির কথা বর্ণনা করেছেন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের করুণতম অধ্যায়ের নাম হচ্ছে বীরাঙ্গনা নারী। যুদ্ধে সকল পক্ষেরই শত্রুর পাশাপাশি কোথাও না কোথাও মিত্রও থাকে। কিন্তু এইসব অসহায় নারীদের মিত্রপক্ষ বলে কিছু ছিল না। সকলেই ছিল তাদের শত্রুপক্ষ, তা সে শত্রুই হোক কিম্বা মিত্র নামধারীরাই হোক। যুদ্ধের সময় নয়মাস তাদেরকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, আল বদর, আল শামস, রাজাকার আর বিহারীদের কাছে শারীরিকভাবে ধর্ষিত হতে হয়েছে। আর যুদ্ধের সময় বা পরে যারা তাদের মিত্র হওয়ার কথা ছিল,পরম স্নেহে বা ভালবাসায় বুকে টেনে নেবার কথা ছিল, সেই বাপ-চাচা, ভাই বেরাদারেরাই তাদেরকে ধর্ষণ করেছে মানসিকভাবে, আরো করুণভাবে, আরো কদর্যরূপে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বীরাঙ্গনাদেরকে তাচ্ছিল্য করে এর কাছাকাছি উচ্চারণের চরম অবমাননাকর একটা নামেও ডেকেছে অনেকে। আমি একে বলি সামাজিক ধর্ষণ। সামাজিক এই ধর্ষণ শারীরিক ধর্ষণের চেয়ে কম কিছু ছিল না বীরাঙ্গনাদের জন্য।
আমাদেরই কারণে যে পঙ্কিলে তাদেরকে পতিত হতে হয়েছিল অনিচ্ছুকভাবে, মমতা মাখানো হাত দিয়ে তাদের গা থেকে সেই পঙ্কিল সাফসুতরো করার বদলে নিদারুণ স্বার্থপরতা এবং হিংস্রতার সাথে আমরা তাদেরকে ঠেলে দিয়েছিলাম আরো গভীর পঙ্কিলের মাঝে। পাছে না আবার গায়ে কাদা লেগে অশুদ্ধ হয় আমাদের এই বিশুদ্ধ সমাজ। অনিচ্ছাকৃত যে গর্ভাবস্থা তারা পেয়েছিলেন শত্রুর কাছ থেকে, সমাজের রক্তচক্ষু এবং ঘৃণার কারণে তা লুকানোটাই ছিল সেই সময় সবচেয়ে বেশি জরুরী কাজ। সমাজকে বিশুদ্ধ রাখতে তাদের কেউ কেউ গর্ভনাশ করেছেন নীরবে, কেউ কেউ আবার নিজের জীবননাশ করেছেন সংগোপনে। আর যারা তা পারেননি, তারা লোক চক্ষুর অন্তরালে সন্তান জন্ম দিয়ে চলে গেছেন অজানার পথে। জন্ম মুহুর্তেই চিরতরে ছিন্ন হয়ে গেছে মা আর তার সন্তানের নাড়ীর টান। দেবশিশুর মত সেই সব যুদ্ধ শিশুরাও এখন কে কোথায় তার কিছুই জানি না আমরা। এর দায়ভার কার ?আমাদের এই সমাজের নয় কি?
আমাদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের জন্য, গণহত্যা চালানোর জন্য আমরা পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা দাবী করি। আমরা নিজেরাই কি আমাদের সেইসব বীরাঙ্গনা এবং তাদের সদ্যজাত সন্তানদের উপর যে চরম অবিচার করেছি, যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছি তার জন্য ক্ষমা চেয়েছি কখনো? চাইনি। চাইনি বলেই যে চাওয়া যাবে না এমন কোন কথা নেই। এখন সময় এসেছে সেই সব বীর নারীদের এবং তাদের প্রসূত যুদ্ধ শিশুদের কাছে জাতিগতভাবেই আমাদের করজোরে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এই বিজয় দিবসে সেই অঙ্গীকারটুকুই বা আমরা করি না কেন?
শহীদ মেহেরুন নেসা
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের ভয়াল কালো রাত্রিতে “অপারেশন সার্চলাইট”-এর নামে পাকবাহিনী বাঙ্গালীদের ওপর চালায় নির্মম গণহত্যা। তার ঠিক দুইদিন পর, ২৭ মার্চে নির্মমভাবে জবাই করে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয় কবি মেহেরুন নেসা, তাঁর মা ও দুই ভাইকে। মেহেরুন নেসার দুই ভাইয়ের মাথা নিয়ে ফুটবলের মতো খেলেছিল সেদিন ঘাতকেরা। মেহেরুন নেসার কাটা মাথা তাঁরই লম্বা চুল দিয়ে ফ্যানের সাথে বেঁধে ঘুরানো হয়, আর নিচে পড়ে থাকে জবাই করা মুরগির মতো রক্তাক্ত মেহেরুন নেসার দেহটা।
২৩ মার্চ পাকিস্তানের “প্রজাতন্ত্র দিবস” হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের পতাকা না উড়িয়ে বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন অদম্য সাহসী এই মানুষটি। এতে ক্ষিপ্ত হয় ঐ এলাকার রাজাকার ও বিহারীরা, কিন্তু তাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেন মেহেরুন নেসা । অবাঙ্গালী ও বিহারীদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হতো মিরপুরের বাঙ্গালীরা। এই অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য গঠিত হয় “অ্যাকশন কমিটি” যেখানে প্রেসিডেন্ট হন মেহেরুন নেসার খুব কাছের বান্ধবী কাজী রোজী ও মেহেরুন নেসা হন সদস্য। ২৫ তারিখেও কমিটির মিটিং শেষে দুই বান্ধবী গল্প করেন দেশের অবস্থা নিয়ে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে অনুমান করে্ন তাঁরা । এর ঠিক দুদিনের মাথায় ঘটে যায় এই নির্মম হত্যাকাণ্ড। ২৭ মার্চ, বেলা ১১ টার দিকে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে মাথায় লাল ও সাদা পট্টি পরে মেহেরুন নেসার মিরপুরের বাসায় আসে কসাই কাদের মোল্লা, হাসিব হাশমি, আব্বাস চেয়ারম্যান, আখতার গুন্ডা, নেহাল ও আরো অনেকে। মেহেরুন নেসা বুঝতে পেরে কুরআন শরীফ বুকে নিয়ে সকলের প্রাণ ভিক্ষা চায়, কিন্তু পিশাচেরা সেই আকুতি শোনেনি। একে একে সবাইকে জবাই করে হত্যা করে তারা, তারপর মেতে ওঠে নারকীয় উল্লাসে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর দুইজন অবাঙ্গালী বিহারীর মুখে শোনা যায় সেই নারকীয় উল্লাসের নির্মম ইতিহাস ।
শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনঃ সেলিনা পারভীন একটি আন্দোলন। একটি প্রতিবাদী চরিত্র। ৩১ মার্চ তার জন্মদিন। একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর লোকেরা তার সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর অন্য দেশ বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর শহীদ সেলিনা পারভীনের দাফন হয় আজিমপুর নতুন গোরস্থানে ।স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা ছিল ‘শিলালিপি’ আর এজন্য ১৯৭১ সালে শিলালিপি কালো তালিকাভুক্ত হয়। তার উপর নেমে আসে পাকিস্তানি বাহিনীর খড়গ। সেদিন ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি। কোনো কোনো অঞ্চল ইতিমধ্যে মুক্ত হয়ে গেছে । শহরে কারফিউ। রাস্তায় মিলিটারি। পাকিস্তানী বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে । ১৩ ই ডিসেম্বর ধরে নিয়ে যাবার পর তাঁর মরদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভুমিতে। যার চোয়ালে ছিলো বেয়নেটের খোঁচার দাগ আর বুকে গুলি। ১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের গুলিতে-বেয়নেটে ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে৷ খুব শীতকাতুড়ে সেলিনার পায়ে তখনও পড়া ছিল সাদা মোজা । এটি দেখেই তাঁকে সনাক্ত করা হয় । ১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো পাকিস্তানের দালাল আলবদর বাহিনীর ঘৃণিত নরপশুরা সেখানেই সেলিনা পারভীনকে হত্যা করে ৷
দেশ স্বাধীনের পরেই পরিবারের সম্মানের কথা ভেবেই নিজেদেরকে লুকিয়ে ফেলেছিল বীরাঙ্গনা নারীরা। এই নিষ্ঠুর সমাজের কাছে কোন চাওয়া-পাওয়া ছিল না তাদের। নিয়তির কাছে সপে দিয়েছিল তারা নিজেদেরকে। যে দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাদেরকে একাত্তরে তার যাতনা ভুলে থাকা রীতিমত অসাধ্য ছিল তাদের জন্য। কিন্তু নিজের সমাজও তাদেরকে গ্রহণ করেনি সহজভাবে। বীরাঙ্গনা নামের উপাধি তাদের সম্মানের চেয়ে অসম্মান হয়ে এসেছিল বেশি। কোন কিছুর প্রত্যাশাই তারা আর করেনি আমাদের কাছ থেকে। তারপরও কি কোন এক দূর্বল মুহুর্তে মনের গহীন কোনে কোন আশা ঝিলিক দিয়ে উঠেনি তাদের মনে। আশা কি জাগেনি যে, যে দেশের জন্য তারা এতো অপমান আর যন্ত্রণা সয়েছেন সেই দেশের কেউ একজন সামান্য একটু সম্মান দেখাবে তাদের। সামান্য একটু মমতা দিয়ে জানতে চাইবে তাদের সুখ দুঃখের কাহিনী। নীলিমা ইব্রাহিমের আমি বীরাঙ্গনা বলছি গ্রন্থে বীরাঙ্গনা রীনা তার আকাঙ্খা প্রকাশ করেছেন এভাবেঃ
" একটি মুহূর্তের আকাঙ্খা মৃত্যু মুহূর্ত পর্যন্ত রয়ে যাবে। এ প্রজন্মের একটি তরুণঅথবা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, বীরাঙ্গনা আমরা তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে। তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঐ পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সংগীতে তোমার কন্ঠ আছে। এদেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। সেই শুভ মুহূর্তের আশায় বিবেকের জাগরণ মুহূর্তে পথ চেয়ে আমি বেঁচে রইবো " ।
পরিশেষেঃ আজকে চষে বেড়াই আমরা ঢাকা শহর-কেউ কেউ চষে বেড়াই সারা দুনিয়া। জীবন-জীবিকার কারনে ! আমাদের স্বাধীন আকাশ করতে গিয়ে যারা চলে গেলেন অবেলায়-তাঁদের প্রতি আমাদের ঋন কি শেষ করতে পারবো ? কিংবা জাতি হিসেবে আমাদের উত্থানে তাঁদের ত্যাগ প্রতিদিন আমাদেরকে আরো ঋনি করে দেয়। মৃত্যূভয়ে ভীত নহে বীর, মানবাধিকার রক্ষায় উচু রাখি শির। আবারো ঐক্যবদ্ধ হই ৭১ এর চেতনায় । আসুন, বীরাঙ্গনা নারী এবং যুদ্ধ শিশুদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মিছিলে সমবেত হই আমরা সবাই। অতীতের পাপমোচনের দায়ভার যে আমাদের সকলেরই।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার।
ফোনঃ ১১৪৭৭১০৯১, ফ্যাক্সঃ ১১৪৭৭৮৬১৫, ই-মেইলঃ alfaqihi.group@yahoo.com
No comments:
Post a Comment
Thank you very much.