পাকিস্তানকোন কালেই একদলীয় রাষ্ট্র ছিল না। সে দেশের কোন গণতান্ত্রিক সরকার দূরেথাক,এমন কি কোন সামরিক সরকারও এমন সিদ্ধান্ত নেয়নি। শুধু আওয়ামী লীগ কেন,আরো বহু দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই পাকিস্তানে কাজ করছিল। এমনকি যে কংগ্রেস পাকিস্তান সৃষ্টির প্রচণ্ড বিরোধীতা করেছিল সে দলটিরওস্বাধীন ভাবে কাজ করার পূর্ণ অনুমতি ছিল। সংসদে এ দলটির সদস্যও ছিল।পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশটির যে গণ-পরিষদ তথা পার্লামেন্ট গঠন করা হয়তার সদস্যরা নির্বাচিত হয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৪৬ সালেরনির্বাচনে। সে গণপরিষদ থেকে কংগ্রেস দলীয় সদস্যদের সদস্যপদও হরণ করা হয়নি।বহু দলীয় রাজনীতি চলেছে আইউব ও ইয়াহিয়া খানের আমলেও। খোদ আওয়ামী লীগও সেবহু দলীয় রাজনীতি থেকে পুরা ফায়দা নিয়েছে। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের শাসনামলেতৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেটি ছিল অতি অবাধ ওনিরপেক্ষ নির্বাচন।মুসলিম লীগে সে নির্বাচনে প্রচণ্ড ভাবে হেরে গিয়েপ্রমাণ করেছিল,তারা নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার কোন চেষ্টা করেনি। সেধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে কোন কালেইদেয়নি। শেখ মুজিবও সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁর শাসনামলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের। সে নির্বাচনে তিনি এবং তার দলের বহু প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। বহু বিরোধী প্রার্থীকে নমিশেন পেপার দাখিল ও নির্বাচনী জনসভা করার সুযোগও দেয়া হয়নি। একদলীয় রাজনীতির শুরু পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পর এবং সেটিবাংলাদেশে। সেটিও স্বয়ং শেখ মুজিবের হাতে,এবং বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে। ফলে প্রমাণ মেলে,শেখ মুজিব ১৯৭০-এর নির্বাচনের শুরুটিই করেছিলেনডাহা মিথ্যা কথা রটনার মধ্য দিয়ে।
স্বৈরাচারি মুজিব
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শেখমুজিব আবির্ভূত হন একজন স্বৈরাচারি ফ্যাসীবাদী নেতা রূপে। শুধু বাংলাদেশেরইতিহাসেই নয়,শুধু সমগ্র উপমহাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নেতা যিনি একদলীয়শাসনের ঘোষণা দেন। এমন স্বৈরাচারি পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা পাকিস্তানে যেমন কোনকালে হয়নি;ভারত, শ্রীলংকা ও নেপালেও হয়নি। সোভিয়েত রাশিয়া,পূর্ব ই্উরোপীদেশগুলি ও চীনের ন্যায় বাংলাদেশেও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারি একদলীয় সরকারপ্রতিষ্ঠা করেন। শেখ মুজিরেব হাতে সর্বময় ক্ষমতা তুলে দেয়ার স্বার্থেই১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুযারিতে শাসনতন্ত্রে আনা হয় সংশোধনী। মাত্র ১১ মিনিটেরমধ্যে ২৯৪জন পার্লামেন্ট সদস্যের ভোটে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার রূপান্তরিত হয় প্রেসিডেন্সিয়াল ফরমে । শেখ মুজিব হন ৫ বৎসরের জন্য-অর্থাৎ১৯৮০ সাল অবধি-নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারি প্রেসিডেন্ট এবং সে সাথে একদলীয়রাজনীতির সর্বেসর্বা। প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য শেখ মুজিব জনতারআদালতে তথা ভোটে যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি। প্রতিষ্ঠা করেন, দেশেরএকমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশাল। তালা ঝুলিয়ে দেন অন্যান্য দলের দফতরগুলিতে।ফরমান জারি করেন, ১৯৭৫ সালের ২৫শে মে’র মধ্যে সকল সংসদ সদস্যকে বাকশালে যোগদান করতে হবে নইলে বাতিল ঘোষিত হবে তাদের সংসদ সদস্যপদ। তার দলীয় সদ্স্যরাতাকে আজীবন প্রেসিডেন্ট করার পাকা বন্দোবস্তও করছিল। ১৯৭৫এর ১৫ আগস্ট মারানা গেলে সে রেকর্ডও যে তিনি প্রতিষ্ঠা করতেন তা নিয়েও কোন সন্দেহের অবকাশনেই। তার দলীয় নেতা ও কর্মীরা মাঠে ময়দানে এক নেতা-একদেশেরর ধারণা জোরে শোরেপ্রচার করছিল। যে দলের কর্মীরা শেখ মুজিবকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীরূপে প্রবল বিশ্বাস রাখে তারা সে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীকে আজীবনের জন্য যেপ্রেসিডেন্ট করতে চাইবে তাতেই বা বিস্ময়ের কি আছে?
দেশে আর কিগণতন্ত্র চর্চা বাড়াবে?গণতন্ত্র মৃত্যুবরণ করেছিল দলটির নিজের মধ্যেই।আওয়ামী লীগের কোন নেতাই সেদিন শেখ মুজিবের একদলীয় স্বৈরাচারি রাজনীতিরবিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। নেতা ও কর্মীগণ পরিণত হয়েছিল বিবেকহীন চাটুকারে।গণতন্ত্রের নামে একটি দল কি ভাবে একদলীয় ফ্যাসীবাদের দিকে ধাবিত হতে পারেতারই নমুনা পেশ করে আওয়ামী লীগ। মুজিব পরিণত হয় বাংলাদেশের হিটলারে। সেদিনএকমাত্র জেনারেল ওসমানী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন -এ দুই ব্যক্তি তারএকদলীয় বাকশালী নীতির বিরোধীতা করে পদত্যাগ করেছিলেন। লক্ষণীয় হলো,এদু’জনের কেউই আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা ছিলেন না। অথচ যারা ছিল আওয়ামীলীগের নিজ ঘরানারপুরোন নেতা ও কর্মী, গণতন্ত্র নিয়ে যাদের ছিল প্রচণ্ডগলাবাজি -তারা সেদিন কোন রূপ নৈতিক মেরুদন্ডের প্রমাণ রাখতে পারেননি।সংসদের ২৯৪জন সদস্যের মাঝে দুইজন বাদে আর কোন ব্যক্তিই সেদিন প্রতিবাদকরেনি। মনের ক্ষোভে দল থেকে পদত্যাগও করিনি। অথচ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরপ্রতি সামান্যতম অঙ্গীকার থাকলে কোন ব্যক্তি কি এমন একদলীয় শাসনকে সমর্থনকরতে পারে? কারণ এটি তো ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানোর মত অপরাধ। অথচসেদিন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও নেতা-কর্মীগণ স্বৈর-শাসনের শুধুসমর্থনই করেননি,সেটির পক্ষে প্রচণ্ড ওকালতিও করেছেন। সেটি নিয়ে সামান্যতমঅনুশোচনা দূরে থাক, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আজও তা নিয়ে প্রচণ্ডঅহংকার। গণতান্ত্রিক চেতনা-বিবর্জিত মেরুদণ্ডহীন কর্মী ও নেতা উৎপাদনে এদলটি যে কতটা সফল কারখানায় পরিণত হয়েছিল,সেটিও সেদিন প্রমানিত হয়েছিল। এমনমেরুদণ্ডহীন নেতা-কর্মীরাই সেদিন দলে দলে এবং উৎসব-ভরে আত্মসমর্পণ করেছিলশেখ মুজিবের একদলীয় স্বৈর-শাসনের কাছে। ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতায়থাকায় ছাড়া এ দলটির আর যে কোন মহত্তর লক্ষ নেই এবং স্বপ্নও নেই -সেটি তারাসেদিন প্রমাণ করেছিল। গণতন্ত্রের বুলি পরিণত হয়েছিল ক্ষমতায় উঠার সিঁড়িরূপে। নিজেরা ক্ষমতায় যাওয়ার সাথে সাথে সে সিঁড়িটাই দূঁরে ছুড়ে ফেলেছে।স্মরণযোগ্য,পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে কোনদিন এমন ফ্যাসীবাদেরপ্রবর্তন ঘটেনি। এমনকি জেনারেল আইউব ও জেনারেল ইয়াহিয়ার ন্যায় জেনারেলগণওগণতন্ত্রের এতবড় শত্রুতে পরিণত হননি। তাদের আমলেও বহুদলীয় রাজনীতি ছিল,বহুবিরোধী দলীয় পত্রিকাও ছিল। অথচ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৪ বছরের মধ্যেইবহুদলীয় রাজনীতির কবর রচিত হলো এবং সেটি আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবেরহাতে। দেশ পরিণত হয়েছিল পুলিশী রাষ্ট্রে। সেদিন নিষিদ্ধ হয়েছিল সকল বিরোধীপত্রিকা। প্রকাশনের অধিকার পেয়েছিল একমাত্র সে সব পত্রিকাই যে গুলিমুজিব-বন্দনাকে নিজেদের ব্রত রূপে গ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানী শাসক জেনারেলইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবকে যে গণতান্ত্রিক অধিকারদিয়েছিল সেটি শেখ মুজিব ও তার দল অতি নিষ্ঠুর ভাবে কেড়ে নিল বাংলাদেশীদেরথেকে । একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বস্তুত তিনি গণতন্ত্রকে সেদিনকবরস্থানে পাঠিয়েছিলেন। দেখা যাক, মুজিব সম্বন্ধে এ নিয়ে তার অতি কাছেরলোকেরা কি বলেন।
“১১ই জানুয়ারি (১৯৭২) টেলিফোন বাজিয়া উঠিল।রিসিভার তুলিয়া একটি পরিচিত কিন্তু অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত কন্ঠস্বর শুনিতেপাইলাম। কন্ঠস্বরটি গণপ্রজাতন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের। কলেজ জীবন হইতেবন্ধু;..টেলিফোনে তাজউদ্দিন কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর আমাকে বলেন,“শেখসাহেবকে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন করিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছি এবং প্রস্তাবওকরিয়াছি। কারণ তিনি যে কোন পদেই বহাল থাকুন না কেন,তাঁহারইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালিত হইবে। শেখ সাহেবের মানসিক গড়নতুমিও জান;আমিও জানি। তিনি সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্থ্। অতএব ক্ষণিকেরভুল সিদ্ধান্তের জন্য পার্লামেন্টারী কেবিনেট পদ্ধতির প্রশাসন প্রহসনেপরিণত হইবে। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকিলে নিয়মান্ত্রিক নাম-মাত্রদায়িত্ব পালন না করিয়া মনের অজান্তে কার্যতঃ ইহাকে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিরপ্রশাসনে পরিণত করিবেন। এই দিকে প্রেসিডেন্ট পদে বিচারপতি আবু সাঈদচৌধুরীকে নির্বাচনের কথা ভাবিতেছি। তোমার মত কি?”তদুত্তরে তাঁহাকে বলি,“তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক। নামমাত্র প্রেসিডেন্টের ভূমিকা পালন শেখ সাহেবেরশুধু চরিত্র বিরুদ্ধ হইবে না; বরং উহা হইবে অভিনয় বিশেষ। কেননা,ক্ষমতারলোভ তাঁহার সহজাত।”তাজউদ্দিন টেলিফোনের অপর প্রান্তে সশব্দে হাসিয়াউঠিলেন। বলিলেন, “আমি জানিতাম,মৌলিক প্রশ্নে তোমার আমার মধ্যে মতভেদ হইবেনা।” -(অলি আহাদ)। উল্লেখ্য,জনাব অলি আহাদ ছিলেন পঞ্চাশের দশকেপূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। সে সময় শেখ মুজিব ছিলেনদলটির সাধারণ সম্পাদক।
ক্ষমতালোভী মুজিব
নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলই ছিল শেখ মুজিবেররাজনৈতিক জীবনের প্রধান লক্ষ্য তা নিয়ে এমন কি তাজউদ্দিন আহমদেরও কোন সন্দেহ ছিল না।ক্ষমতার নেশায় তিনি কখনও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন,কখনও প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।কখনও বা জরুরী আইন জারি করে জনগণের সকল নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়েছেন এবং সকলক্ষমতা নিজে কুক্ষিগত করেছেন। শেষের দিকে এসেসকল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকেনিষিদ্ধ করেন। হরণ করেন বাক স্বাধীনতা। একমাত্র সামরিক ক্ষমতা বলে অপসারণছাড়া রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আর কোন পথই তিনি খোলা রাখেননি। অবশেষে সে পথেইতাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এই হলো তার রাজনৈতিক জীবন। কথা হলো,তাঁর এক্ষমতালোভী ও স্বৈরাচারি রাজনৈতিক জীবন কি কোন সভ্য দেশের ও সভ্য মানুষেরজন্য মডেল হতে পারে? অথচ বাংলাদেশের আওয়ামী-বাকশালী চক্র তাঁর সে রাজনীতিনিয়েই গর্বিত। তাদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিব সর্ব কালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। তাঁর সেরাজনীতির মডেল তারা পুনরায় বাস্তবায়ন করতে চায়।
তবে যুগে যুগে স্বৈরাচারিশাসকদের সমর্থক চাটুকার মোসাহেবদের আচরণ অবিকল এমনটিই ছিল। এজন্য সেসবস্বৈরাচারি শাসকদের অতি মানব বা মহামানব হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। যুগে যুগেদস্যু চরিত্রের বহু নৃশংস মানুষও এসব চাটুকরদের থেকে শ্রদ্ধ| পেয়েছে, এমনকিপূজাও পেয়েছে। দুর্বৃত্ত ফিরাউনকে তো তার তাঁবেদার প্রজারা ভগবান মনেকরতো। খোদার আসনে বসিয়ে তাকে শুধু আনুগত্য ও রাজস্বই দিত না,প্রাণও দিত।তারাই তার স্মৃতিকে স্মরণীয় করতে বছরের পর বছর ধরে বহু অর্থ ব্যয়ে ও বহুপ্রাণের বিনিময়ে পিরামিড নির্মাণ করেছিল। আর এরাই হযরত মুসা (আঃ)কে মনেকরতো দুর্বৃত্ত। হযরত মুসা (আঃ)র হত্যায় ফিরাউনের নেতৃত্বে তারা সাগরপর্যন্ত ধেয়ে গিয়েছিল। অবশেষে মহান আল্লাহপাক এ দুর্বৃত্ত ফিরাউন ও তারসাথীদের সমুদ্রে ডুবিয়ে হত্যা করেছিলেন। হিটলারকেও তার ভক্তরা সর্বকালেরশ্রেষ্ঠ জার্মান মনে করতে। তার হুকুমে তারা লাখে লাখে প্রাণ দিয়েছে। মানুষযখন আল্লাহতে অজ্ঞ ও ঈমানশূন্য হয়,তখন তারা আচরণ যে কতটা বিস্ময়কর ভাবেনীচে নামতে পারে সে উদাহরণ তো ইতিহাসে প্রচুর। মানুষ কেন,মানবেতরসাপ-শকুন-গরু-বাছুরকেও এসব জাহেলেরা তখন দেবতার আসনে বসায়।সাপ-শকুন-গরু-বাছুরের তুলনায় ফিরাউন,হিটলারেরা তো অনেক শক্তিধর ছিল। তারাবড় বড় যুদ্ধ জয় করেছে,লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যায় প্রচণ্ড সামর্থ্য দেখিয়েছেএবং বড় বড় রাষ্ট্রও নির্মাণ করেছে। তাই যারা আজ শেখ মুজিবকে সর্বকালেরসর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বলে,তাদের আচরণেও বিস্ময়ের কিছু আছে ক
ভারতসেবী নীতি
দেখাযাক,কিরূপ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে শেখ মুজিবের নিজের ধারণা।একাত্তরে ৯ মাস যুদ্ধচলা অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রীজনাব তাজউদ্দিনের মুজিব নগর সরকার ছিল ভারতের আশ্রীত সরকার। এমন সরকারেরকোন মেরুদণ্ড থাকে না। জনাব তাজউদ্দিন ও তার মন্ত্রীদের প্রতিদিনের থাকা,খাওয়া-দাওয়া ও ভরন-পোষনের সমুদয় ব্যয় বহন করত দিল্লীর ইন্দিরা গান্ধীসরকার। খাঁচার পাখির নিজে শিকার ধরার সামর্থ্য থাকে না,মনিব যা দেয় তাই খেতেহয়। মনিবের মন জোগাতে তখন তার শেখানো বুলিও তখন গাইতে হয়। তাজউদ্দিন সরকারেরঅবস্থাও তাই ছিল। ফলে তাকে দিয়ে ভারত সরকারও খুশী মত চুক্তিও সই করিয়েনেয়। কোন স্বাধীন দেশ এমন চুক্তি কখনও স্বাক্ষর করে না। তাজউদ্দিনেরস্বাক্ষরিত ৭ দফা চুক্তিনামাটি ছিল নিম্নরূপঃ
১। ভারতীয়সমরবিদদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা হইবে।গুরুত্বের দিক হইতে এবং অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যায় এই বাহিনী বাংলাদেশের মূলসামরিক বাহিনী হইতে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ হইবে। (পরবর্তীকালে এই চুক্তির আলোকেরক্ষী বাহিনী গড়া হয়)।
২। ভারত হইতে সমরোপকরণ অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করিতে হইবে এবং ভারতীয় সমরবিদদের পরামর্শানুযায়ী তাহা করিতে হইবে।
৩। ভারতীয় পরামর্শেই বাংলাদেশের বহিঃবাণিজ্য কর্মসূচী নির্ধারণ করিতে হইবে।
৪। বাংলাদেশের বাৎসরিক ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ভারতীয় পরিকল্পনার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হইতে হইবে।
৫। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির অনুরূপ হইতে হইবে।
৬। ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিগুলি ভারতীয় সম্মতি ব্যতীত বাতিল করা যাইবে না।
৭।ডিসেম্বরপাক-ভারত যুদ্ধের পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ভারত যে কোন সময় যেকোন সংখ্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে পারিবে।
উপরেবর্ণিত চুক্তিগুলিতে মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন স্বাক্ষরকরেন। কিন্তু তাজউদ্দিনের বদলে যখন শেখ মুজিব ক্ষমতা হাতে নিন তখনও কিভারতের প্রতি এ নতজানু নীতিতে সামান্য পরিবর্তন এসেছিল? আসেনি। তাজউদ্দিনযে দাসখতে স্বাক্ষর করেছিলেন সেগুলো শেখ মুজিবও মেনে নেন। "১৯৭২ সালের ১৯মার্চ ঢাকার বুকে বঙ্গভবনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওবাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান স্বাক্ষরিত ২৫ সাল বন্ধুত্বসহযোগিতা ও শান্তিচুক্তিতে সেগুলি সন্নিবেশিত করা হয়।" -(অলি আহাদ)
অর্থনৈতিক নাশকতা
শেখ মুজিব যে শুধু গণতন্ত্রের বিনাশ করেছেন তাই নয়। প্রচণ্ড নাশকতা ঘটিয়েছেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিব বাংলার মানুষের বহু অর্থনৈতিক কল্যানের বড় বড় কথাবলেছেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি ও তার দলের হাতে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলিতে। প্রতিটিদেশের দেশপ্রেমিক সরকার শুধু দেশবাসীকে বিদেশী শক্তির সামরিক আগ্রাসন থেকেইরক্ষা করে না,রক্ষা করে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক হামলা থেকেও।প্রতিদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক সরকারই এমন একটি অঙ্গীকার নিয়েই সেদেশেকঠোর ভাবে দিবারাত্র সীমান্ত পাহারা দেয়,যাতে বিদেশী পণ্যের সয়লাবে নিজদেশের পণ্যগুলো বাজার না হারায়। একাজটি যাতে সুচারু ভাবে হয় সে জন্যপ্রতিটি দেশপ্রেমিক সরকারই বিপুল অর্থ ব্যয়ে সীমান্তরক্ষিবাহিনী গড়ে তোলে।এক্ষেত্রে আপোষ চলে না। সামরিক প্রতিরক্ষার চেয়ে অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষারবিষয়টি কোন দেশের জন্যই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বহীন ছিল না বাংলাদেশেরজন্যও। কারণ,নিজদেশের পণ্য বাজার হারালে সে পণ্যের উৎপাদনকারি শ্রমিকগণতখন বেকার হয়। এজন্যই প্রতিদেশের দেশ-প্রেমিক সরকার শুধু নিজদেশে নয়,বিপুলউদ্যোগে বিদেশেও বাজার খুঁজে। একাজে ব্যর্থ হলে ভিখারি হওয়া ছাড়া আর কোনরাস্তাই থাকে না। মুজিব আমলে বাংলাদেশের ভাগ্যে সেটিই জুটেছিল। এমন একটিগুরুত্বপূর্ণ কাজে মুজিবের কোন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অঙ্গীকার ছিল না। ফলেসেদিন বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম রাষ্ট্র বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছিল "তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি" রূপে। মুজির আমলের এটিই ছিল সবচেয়ে বড় অর্জন। আগামীহাজার হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষকে এ বদনামের বোঝা ও কলংক বইতে হবে।অথচ দেশটির অতীত ইতিহাসে এ পরিচয় কোনকালেই ছিল না। বরং বাংলার মসলিন শিল্পতখন বাজার পেয়েছে নানা দেশের নানা জনপদে।
ভারত শুরু থেকেইচাচ্ছিল,বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূগোল বিলুপ্ত করা যদি সম্ভব না হয়,অন্ততঅর্থনৈতিক সীমান্ত লোপ করা। যাতে ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের বাজারে অবাধেপ্রবেশাধিকার পায়। এটি ছিল ভারতীয় বিদেশ নীতির গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজী। আরএ লক্ষ্যে ভারতকে বেশী দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। পাকিস্তান থেকে শেখ মুজিবেরফিরে আসার তিন মাসের মধ্যে ভারত তার থেকে সে অধিকার আদায় করে নেয়।রাজনৈতিক,সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণে একটি দেশের দেশপ্রেমিকসরকারের যে প্রবল রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকে,সেটি শেখ মুজিব ও তাঁরনেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ছিল না। ভারত ১৯৭২ সালের ২৭ইমার্চ মুজিব সরকারের সাথে সীমান্তের ২০ মাইল অবাধ বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনকরে। আর এ চুক্তি মোতাবেক ভারতীয় পণ্যের জন্য সমগ্র সীমান্ত খুলে দেন। ফলেভারত অনায়াসেই পায় বৃহৎ বাজার। ভারত পূর্ব পাকিস্তানেরও প্রতিবেশী ছিল।কিন্তু অখণ্ড পাকিস্তান তার ২৩ বছরে একটি দিনের জন্যও ভারতীয় পণ্যের জন্যসীমান্ত খুলে দেয়নি। প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা খরচ করে বরং সীমান্ত পাহারাদিয়েছে যাতে নিজ দেশের পণ্য বিদেশী হামলার মুখে না পড়ে। ফলে সে আমলেভারতের চেয়ে দ্রুত গতিতে বেড়েছে শিল্পোন্নায়ন। বেড়েছিল কুঠির শিল্প। তখনবিড়ি তৈরী করেই লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করত। ব্যাপক ভাবে বেড়েছিলতাঁতশিল্প। অথচ মুজিব সে নিরাপত্তা দিতে পারেনি দেশের ক্ষুদ্র শিল্পকে।ফলে দ্রুত ধস নেমে আসে দেশের অর্থনীতিতে। বন্ধ হয়ে যায় দেশের কলকারখানা এবংধ্বংস করা হয় কুটির শিল্প। শুধু ভারতীয় পণ্যের জন্য বাজার করে দেয়ারলক্ষ্যে। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ তখন বেকার হয়ে নেমে আসে ভয়াবহদুর্ভিক্ষ। আর এতে অনাহারে প্রাণ হারিয়েছে বহু লক্ষ মানুষ। মুজিব শুধু নিজের গদীরস্বার্থে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য এমন ভয়ানক বিপদ ডেকে আনে।
অধিকৃত হলো দেশ
১৯৭১-এরযুদ্ধে বিজয়ে ভারতের প্রভূত রাজনৈতিক ও সামরিক সুবিধা পেয়েছিল। বিশ্বেরসর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংসের মধ্য দিয়ে তারা নিজেরা যে শুধু বিপুলআনন্দ পেয়েছে তা নয় গভীর আনন্দ দিয়েছে ইসলামের তাবত দুশমনদের। ভারত তার প্রধানতম প্রতিদ্বন্দীকে দ্বিখণ্ডিত করে নিজে দক্ষিণএশিয়ায় অপ্রতিদ্বন্দি হয়েছে সেটি সত্য। তবেএ রাজনৈতিক ও সামরিক সুফল লাভের পাশাপাশি ভারতের সবচেয়ে বড় লাভটি হয়েছিলঅর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাজার লাভটি ছিল তার সবচেয়ে বড় বিজয়। এটিছিল ভারতের পশ্চিম বাংলা,বিহার ও আসামের সম্মিলিত আভ্যন্তরীন বাজারেরচেয়েও বিশাল। এক কালে এ বাজার দখলের জন্যই ইংরেজেরা হাজার হাজার মাইল দূরথেকে এ দেশটিতে ছুটে এসেছিল। তবে ভারত শুধু বাজার দখল করেই ক্ষান্ত দেয়নি।বাংলাদেশের পণ্য যাতে নিজ দেশে এবং বহিঃবিশ্বে ভারতীয় পণ্যের বিরুদ্ধেপ্রতিযোগিতা না করতে পারে তারও পাকা ব্যবস্থা করেছিল।
ইংরেজেরা তাদেরপণ্যের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা নির্মূল করতে বাংলাদেশের মসলিন শিল্পেরতাঁতীদের হাত কেটেছিল। সে অভিন্ন লক্ষ্যে ভারত বাংলাদেশের তাঁতীদেরই শুধু নয়,পুরা শিল্পকেই ধ্বংস করেছিল। আর সে শিল্প ধ্বংসে ভারতকে পূর্ণ সহযোগিতাদিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীবাহিনা। এবং সবচেয়ে বেশী সহযোগিতাদিয়েছিলেন শেখ মুজিব নিজে। শেখ মুজিব দেশের সমস্ত শিল্পকারখানা জাতীয়করণকরেছিলেন,সেগুলিকে কেড়ে নিয়েছিলেন তাদের আসল মালিকদের থেকে। এবং তুলেদিয়েছিলেন তার অযোগ্য ক্যাডারদের হাতে। আর এ ক্যাডারগণ যে শুধুশিল্প-পরিচালনায় অযোগ্য ছিল তাই নয়,সীমাহীন দুর্নীতি পরায়নও ছিল। অন্যেরকোল থেকে কেড়ে আনা সন্তানের প্রতি অপহরণকারি ব্যক্তির দরদ থাকে না। তেমনিবাংলাদেশের শিল্পের প্রতি দরদ ছিল না এসব আওয়ামী ক্যাডারদের। এরা নিজেদেরশ্রম ও অর্থ ব্যয়ে দেশে কোন শিল্পই গড়েনি,পাকিস্তান আমলে গড়া শিল্পকে তারাদখলে নিয়েছিল মাত্র। ফলে তাদের দরদ ছিল না সেসব প্রতিষ্ঠিত শিল্পকলকারখানার উপর। দেশের স্বার্থের চেয়ে তাদের কাছে ব্যক্তিস্বার্থইপ্রাধান্য পেয়েছিল।
সে অযোগ্যতা,দুর্নীতি ও শিল্পধ্বংসের কিছুউদাহরণ দেয়া যাকঃ “আদমজী জুট মিল ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল। পাটজাতদ্রব্য বিদেশে রফতানি করে এ মিলটি শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয়করেছে। ভারতের পাটকলগুলির সামর্থ্য ছিল না তার সাথে প্রতিযোগিতার। অথচ মুজিবসরকার এত বড় একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানকে লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। শেখমুজিব এ মিলের দায়িত্বে বসিয়েছিলেন তারই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। উৎপাদন বাড়ানোরচেয়ে এ মিলের মূল কাজ হয় আওয়ামী লীগ কর্মীদের এ মিলে চাকরি দিয়ে প্রতিপালনেরব্যবস্থা করা। ১৯৭৪ সালের ২২ই মার্চ ইত্তেফাক এ মর্মে খবর ছেপেছিল যে পাটশিল্পে ২৫ হাজার বাড়তি ও ভুয়া শ্রমিক এবং ৩ হাজার ৬ শত ভুয়া কর্মকর্তারয়েছে।” -(মুনির উদ্দীন আহমদ, ১৯৮০)।
কথা হলো,একটি মাত্র মিলে যদি ২৫হাজার ভুয়া শ্রমিক দেখিয়ে রাজনৈতিক ক্যাডার পালনের ব্যবস্থা করা হয় তবে সেকারখানা যত লাভজনকই হোক তা কি টিকে থাকতে পারে? এসব কর্মীরা লুটপাট ছাড়া এমিলের আর কোন খেদমতই করেনি। সে লুটপাটেরই এক করুন চিত্র ছেপেছিল সে সময়েরদৈনিক গণকন্ঠ ১৯৭২ সালের ২৭ অক্টোবর সংখ্যায়। শিরোনামটি ছিল,“আদমজী জুটমিলের ওয়ার্কশপে এলাহী কান্ডঃ প্রায় দেড় লক্ষ টাকার খুচরা যন্ত্র গোপনেবিক্রি।”বিরামহীন লুটের মাধ্যমে এ বিশ্ববিখ্যাত মিলটি তারা অচল করেদিয়েছে। অথচ এ মিলের মুনাফা দিয়ে এক সময় দেশে আরো অনেক কলকারখানা গড়াহয়েছিল। গড়ে উঠেছিল বহু স্কুল-কলেজ ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। কিন্তুআওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি ও ভারত-তোষণ নীতির ফলে অসম্ভব হয় এ মিলটির নিজেরপক্ষে বেঁচে থাকাটিই। শুধু আদমজী জুটমিলই নয়,ধ্বংসের মুখোমুখি হয় অন্যান্যকলকারখানাগুলিও। একের পর এক পাটের গুদামে আগুন লাগানো হয়েছে। বাংলাদেশেরপাট শিল্প এভাবে ধ্বংস হওয়াতে রম-রমা হয়েছে ভারতীয় পাটকলগুলো। তারা তখনসহজেই দখল করে নেয় পাটজাত দ্রব্যের আন্তর্জাতিক বাজার। এমন কি বাংলাদেশসরকার ১৯৭৪ সালে ভারতের সাথে চুক্তি করে পাট রপ্তানির অধিকার ভারতের হাতেসঁপে দেয়। আর এর ফলে ৫৯ হাজার জুটবেলিং শ্রমিক বেকার হয়ে যায়।- (গণকন্ঠ জুন১২, ১৯৭৪)। পাকিস্তান আমলে ভারত এমনটি ভাবতেও পারেনি। শুধু বড় বড়কলকারখানাই নয়,একই রূপ দুর্নীতির মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছিল বাংলাদেশেরকুটির শিল্প। সূতা আমদানি ও তার বিতরণ আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে দিয়েপ্রকৃত তাঁতীদের হাতে ন্যায্য দামে ও সঠিক মূল্যে সূতা পৌঁছানোর ব্যবস্থাঅসম্ভব করেছিল। ফলে ভারতীয় সস্তা ও নিম্নমানের কাপড়ের সাথে প্রতিযোগীতার সামর্থ্যহারায় বাংলাদেশের তাঁতীরা। ফলে বেকার হয়েছিল এবং দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছিলপাকিস্তান আমলের স্বচ্ছল তাঁতীরা। বাংলাদেশের শিল্প ওঅর্থনীতির ক্ষেত্রে এ ছিল আওয়ামী লীগের প্রকৃত অবদান।
শেখ মুজিববাংলাদেশকে নিয়ে কিরূপ স্বপ্ন দেখতেন সেটি জনগণের জানার উপায় ছিল না। সেটিতার অদৃশ্য মনজগতের বিষয়। তবে বাংলাদেশকে তিনি যেখানে নিয়ে গেছেন সেটিশুধু বাংলাদেশের মানুষই শুধু দেখেনি,বিশ্ববাসীও দেখেছে। দেশটির বহুহাজারবছরের ইতিহাসে এমন দুর্দশা মূলতঃ নজিরবিহীন। এতটা দুরবস্থায় বাংলাদেশকোন কালেই পড়েনি। তবে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীগণ নিজেদের এ ব্যর্থতা লুকাতেঅন্যদের গায়ে কালীমা লেপনের চেষ্টা করেছে। এজন্যই একাত্তরের মিথ্যা ইতিহাসরচনায় আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের এত উদ্যোগ। একাত্তরের কতজন মারা গেল সেহিসাবটুকু না নিলে কি হবে,বহু হাজার পৃষ্ঠার বহু লিখেছে নিছক বিরোধীদেরখুনী ও দালাল রূপে চিত্রিত করতে। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পূর্বে এ আওয়ামীপক্ষটি “পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন?”শিরোনামে পোস্টার ছেপে সারা দেশেপ্রচার করেছিল। কিন্তু তাদের কথিত সে শ্মশান আমলে পূর্ব বাংলার মানুষ কিকখনও দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছিল? কাপড়ের অভাবে কি মহিলা মাছধরার জাল পরেছিল? এক দিনের জন্যও কি দেশ ভিক্ষার ঝুলিতে পরিণত হয়েছিল? পাকিস্তান আমলের পূর্বপাকিস্তানকে যারা শ্মশান বলল,তারাই একাত্তরের পর দেশটিকে বদ্ধভূমি ওশ্মশান বানিয়ে বিশ্বের সামনে পেশ করেছিল।
শিক্ষাক্ষেত্রে নাশকতা
শেখ মুজিব যে শুধুগণতন্ত্র হত্যা করেছেন,দেশের অর্থনীতি ও সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করেছেন বা জাতিকে ভারতের গোলামবানিয়েছেন তা নয়,তার চেয়েও বড় ক্ষতি করেছেন জাতির মেরুদণ্ড ধসিয়ে দিয়ে।শিক্ষাই হলো জাতির মেরুদণ্ড। এখানে কোন ফাঁকি-বাজি চলে না। জ্ঞানার্জনেরকোন সহজ রাস্তা নেই।একটি দেশের মেরুদণ্ড ভাঙতে হলে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাভেঙ্গে দেয়াটাই সে জন্য যথেষ্ট। এ কাজ শত্রুদের। তাই দেশের কল্যাণে কোননেতার সামান্যতম আগ্রহ থাকলে শিক্ষাব্যবস্থার সামান্যতম ক্ষতি হবে এমনসিদ্ধান্ত তিনি নেন না। কিন্তু শেখ মুজিব নিয়েছিলেন। একাত্তরের যুদ্ধচলাকালীন ৯ মাসে বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হয়নি। কিন্তুলেখাপড়া না হলে কি হবে শেখ মুজিব ছাত্রদের নাম-মাত্র পরীক্ষা নিয়ে বাপরীক্ষা না নিয়েই পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশনের ব্যবস্থা করলেন। ফলে যুদ্ধকালীননয় মাসে ছাত্রদের যা শেখা উচিত সেটা শেখা ও শেখানোর আর কোন সুযোগই থাকলনা। সরকার শেখানোর ব্যবস্থাও করল না। এমনকি মেডিকেল কলেজগুলোতেপ্রাকটিক্যাল পরীক্ষা না নিয়ে পাসের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে প্রচুরসার্টিফিকেট বিতরণ হলো,কোন জ্ঞান বিতরণ ছাড়াই। তার আমলে পরীক্ষার হলেব্যাপক ভাবে নকল শুরু হয়। নকল সরবরাহকারিরা তখন বই নিয়ে পরীক্ষার হলে গিয়েহাজির হত। মুজিব সরকার সেটি রুখবার কোন ব্যবস্থাই নিল না। দায়িত্বহীনতা আরকাকে বলে? জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে চুরি বা দুর্নীতি শুরু হলে তার চেয়েমারাত্মক আর কি হতে পারে। তখন সে চুরিবিদ্যার প্রয়োগ শুরু হয় অফিস-আদালত ওব্যবসা-বাণিজ্যে। একটি জাতির জন্য এরচেয়ে বড় আত্মঘাতী আর কি হতে পারে? কিন্তু আত্মঘাতী রাজনীতি যাদের আজীবনের পেশা তাদের কাজে এত বড় অপরাধ কোনঅপরাধই মনে হয়নি। ছাত্রদেরকে তিনি ও তার বশংবদেরা সচারচরই ব্যবহার করেছেনসন্ত্রাসী রাজনীতির অবৈতনিক লাঠিয়াল রূপে। তার আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ক্যাম্পাসে তার দলীয় ছাত্রনেতাদের দ্বারা ছাত্র খুন হয়েছে প্রকাশ্যে।কিন্তু এজন্য কারো কোন শাস্তি হয়নি। বরং মুজিবের দ্বারাই সরকারি ভাবে শুরুহয় বিচারবহিঃর্ভূত হত্যার ঘটনা। তার আমলে বিচার ছাড়াই শুধু বন্দী সিরাজসিকদারকেই হত্যা করা হয়নি, রক্ষী বাহিনী ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হত্যাকরেছে হাজার ছাত্র ও যুবককে। বহু কলেজের প্রিন্সিপাল পদে বসানো হয়েছিলআওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারদের।
শিক্ষাক্ষেত্রে যে সীমাহীন নৈরাজ্য,দুর্নীতি ও শিক্ষাদানে অবব্যবস্থা তিনি সৃষ্টি করেছিলিন সেটিবাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এ সাংঘাতিক খবর ছড়িয়ে পড়িছিল বিশ্বেরঅন্যান্য দেশেও। ফল দাঁড়ালো,বাংলাদেশী ডিগ্রি বিদেশে মূল্য হারালো,এবংএভাবে ইজ্জত হারালো দেশের শিক্ষিতরা। ইংল্যান্ডসহ অনেক দেশই বাংলাদেশের মেডিকেলকলেজগুলোর স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেয়। এভাবে বহিঃবিশ্বে বেইজ্জতি বাড়েবাংলাদেশী ডাক্তারদের এবং সে সাথে শিক্ষা ব্যবস্থারও। শেখ মুজিব এভাবেকালিমা লেপন করলেন, বাংলাদেশী শিক্ষিতদের মুখে। মুজিবামলে ট্রান্সপ্যারেনসীইন্টারন্যাশনাল জন্ম নেয়নি। সেটির জন্ম হলে দুর্নীতি পরিমাপের সেআন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশ যে সে আমলেও বিশ্বে বিশাল ব্যবধানে প্রথমহত,তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? একটি গাছকেও বটগাছের ন্যায় বেড়ে উঠতে সময় লাগে। তেমনি সময় লাগে দূর্নীতির ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম হতেও। তাই বাংলাদেশ যে ভাবে দুর্নীতিতে বিশ্বেবার বার প্রথম হয়েছে সেটি এক বছর বা দশ বছরের অর্জন ছিল না,বরং সেটির ব্যাপক চর্চা শুরু হয়েছিল মুজিব আমল থেকেই।
অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তি
কারোসততা তার কথায় বা বক্তৃতায় ধরা পড়ে না। সমাজের অতি দুর্বৃত্ত ব্যক্তিটিও নিজেকে সৎ ওনির্দোষ বলে দাবী করে। তবে প্রতি সমাজেই সততা পরিমাপের কিছু গ্রহণযোগ্যমাপকাঠি আছে। তা হলো,তার আয় এবং গচ্ছিত সম্পদের হিসাব। একজন ভদ্রলোকেরপক্ষে তার আয় ও সম্পদ কোনটাই লুকানোর বিষয় নয়। চাকরি,ব্যবসা-বাণিজ্য বাচাষাবাদ যাই সে করুক না কেন তা থেকে যেমন তার সমুদয় আয়ের একটি হিসাব যে কেউবের করতে পারে। তেমন তার ঘরবাড়ি ও গচ্ছিত সম্পদের পরিমাণ কত সেটিরও একটিহিসাব বের করা যায়। আয়ের সাথে সম্পদের সে অসঙ্গতিই বলে দেয় তার আসল সততা।তখন বেরিয়ে আসে সে কতটা দুর্বৃত্ত। এ বিচারে বিশাল আদালত বা তদন্ত কমিশন বসানো লাগে না।তাই মোটা বেতনের চাকরি নাই,বিশাল ব্যবসা-বাণিজ্য বা কলকারখানা নেই,পিতার জমিদারীও নাইএমন ব্যক্তি যদি ধানমন্ডি,গুলশান বা বনানীতে বিশাল বাড়ীর মালিক হন,তখনকি গবেষণার প্রয়োজন পড়ে এটুকু বুঝতে যে লোকটি আর যাই হোক সৎ হতে পারে না? শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর তার গৃহে প্রাপ্তসম্পদের একটি তালিকা করা হয়। ৩০ শেঅক্টোবর (১৯৭৫) দৈনিক ইত্তেফাক মোতাবেক শেখ মুজিবর রহমানের ধানমন্ডিস্থ ৩২নং সড়কের ব্যক্তিগত বাসভবনে প্রাপ্ত সম্পদের বিররণ হলঃ
০ হীরা,মুক্তা, প্লাটিনাম ও স্বর্ণালঙ্কর - ৭ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা
০ নগদ বাংলাদেশী টাকা- ৯৪ হাজার ৪ শত ৬১ টাকা
০ ব্যক্তিগত মোটর গাড়ী - ৩ টি
০ বৈদেশিক মুদ্রা ১৭ হাজার ৫ শত টাকা (সমমূল্যের)
০ বিদেশী রাষ্ট্র প্রদত্ত ১ লক্ষ টাকার উপহার
০ বাতিলকৃত শতকী নোট - ৬ শত ২১ খানা
০ ১টি ভারী মেশিনগান, ২টি হালকা মেশিনগান, ৩টি এস,এম,জি, ৪টি স্টেনগান, ৯০ টি গ্রেনেডসহ গোলাবারুদ ইত্যাদি।
মুজিবেরচরিত্র বাংলাদেশের ইতিহাসের গোপন বিষয় নয়। তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক সততা যাচাইয়ে বহু দলিল ও বহু প্রমাণ তিনি জনসম্মুখে রেখে গেছেন। তার রাজনৈতিক কর্ম ও আচরণ দেশী-বিদেশী কোটি কোটিমানুষ স্বচোখে দেখেছে। রাজনৈতিক চরিত্রেরপাশাপাশি অকাঠ্য দলিল রয়েছে তাঁর অর্থনৈতিক চরিত্র বিচারেও। মনের কথা বা মনের আসল রূপটি গোপন করা গেলেও গোপন করা যায় না অসৎ পথে অর্জিত বিশাল সম্পদ। ব্যক্তির চরিত্র পরিমাপে এ গচ্ছিত সম্পদই হলো প্রকৃতগজ-ফিতা। চরিত্র তাই লুকানো যায় না।একারণেই প্রতি দেশে সততা বা ন্যায়পরায়নতা যাচাইয়ে নাগরিকের গচ্ছিত সম্পদের তথ্য নেয়া হয়। বহু দেশেরসরকারই কড়া নজরদারি রাখে নাগরিকদের গচ্ছিত সম্পদের উপর। তাই মুজিবের চরিত্রবিচারে এ গচ্ছিত সম্পদ যে সুস্পষ্ট সাক্ষ্য দেয় সেটি কি অস্বীকার করা যায়? মুজিব ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। তাঁর কোন ব্যবসা বাণিজ্য ছিল না। তাঁর জীবনের বহু বছর কেটেছে জেলে। এত দীর্ঘকাল জেলে থাকলে তার ঘরবাড়ী-সহায়সম্পদ বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাঁর পিতাওকোন বিত্তশালী লোক ছিলেন না। তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন,প্রধানমন্ত্রীহয়েছেন। সে সুবাদে কিছু সরকারি বেতনও পেয়েছেন। কিন্তু কথা হলো,সে বেতন যতবিশালই হোক,তা দিয়ে কি এরূপ গচ্ছিত সম্পদ গড়ে উঠে? কেনা যায় কি তিনটি মোটরগাড়ি? জমে উঠে কি লাখ লাখ টাকার সম্পদ? নির্মিত হয় কি ধানমন্ন্ডির বিশালবাড়ী? বাংলাদেশে যিনি সর্বোচ্চ সরকারি বেতন পান তার পক্ষেও এত সম্পদেরমালিক হওয়া অসম্ভব।তাই প্রশ্ন,কোথা থেকে পেলেন তিনি এ বিশাল সম্পদ? এসম্পদ যে সৎ উপায়ে অর্জিত হয়নি তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে?
অপমান বেড়েছে দেশের
যে ব্যক্তিসম্পদ-অর্জনে সৎ নন,তিনি কি রাজনীতিতেও সৎ হতে পারেন? কথা হলো,এমনব্যক্তিকে কি সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীর আসনে বসানো যায়? আর সেটি করলে কি একটি জাতিরইজ্জত থাকে? থাকে না বলেই,বহু পাশ্চাত্য দেশে মিথ্যা বললে বা আয়ের সাথেসঙ্গতি নাই এমন গচ্ছিত সম্পদ ধরা পড়লে এমন ব্যক্তিকে কোন দলই মন্ত্রীত্বদেয় না,এমন কি দলীয় সদস্যপদও দেয় না। কোন চরিত্রহীন দুর্বৃত্তকে নেতা বা মন্ত্রী বানালেদুর্বৃত্তের ক্ষতি হয় না,বরং ভয়ানক ক্ষতি এবং সম্মানহানী হয় তাদের যারা তাঁকেনেতা বানায়। এটি অনেকটা গলিত আবর্জনা মাথায় করে বিশ্ব-দরবারে দাঁড়ানোর মত।তাই কোন বিবেকমান জাতিই দুর্বৃত্তের দায়ভার মাথায় নেয় না,বর্জ-আবর্জনারন্যায় তাকেও ইতিহাসের আবর্জনার স্তূপে ফেলে দেয়। দুর্নীতিপরায়ন ব্যক্তিরপ্রকৃত স্থান তাই জেলে,সমাজে নয়। দুর্নীতিই একটি ব্যক্তির চরিত্রের সবচেয়েবড় কলংক। আর এমন ব্যক্তিকে সম্মান দিলে অসম্মান ও অপমান বাড়ে সমগ্র জাতির। আরআওয়ামী লীগ বাংলাদেশের অপমান বাড়িয়েছে শুধু দেশকে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলিবানানোর মধ্য দিয়ে নয়,বরং সবচেয়ে বড় অসম্মান বাড়িয়েছে প্রমাণিত দুর্নীতিবাজদেরমাথায় তুলে।
No comments:
Post a Comment
Thank you very much.