৭ ই মার্চের ভাষণের কিছু ইতিকথা
আওয়ামী লীগ আবদার করছে, শেখ মুজিবের ৭ ই মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে মেনে নেয়ার। কারন ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে তিনি বলেছেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পরে ডেভিড ফ্রষ্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিব এ দাবীকে নাকচ করে বলেছেন, ৭ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষনা দেননি। বাস্তবতা হলো, শেখ মুজিব নিজেও কখনো স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছেন বলে দাবী করেননি বরং অস্বীকার করেছেন। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারী প্রখ্যাত বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট (যিনি সম্প্রতি মৃত্যুবরন করেছেন) শেখ মুজিবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ’আপনি যদি বলতেন, ’আমি স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষনা দিচ্ছি তাতে কি ঘটতো,। শেখ মুজিবের জবাব ছিলো, ’বিশেষ করে এই দিনটিতে আমি তা করতে চাইনি যে তারা (পাকিস্তান) বলুক ’শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষনা করেছে এবং আঘাত হানা ছাড়া কোন বিকল্প নেই’। (সূত্র, বাঙালী হত্যাকান্ড ও পাকিস্তানের ভাঙ্গন, মাসুদুল হক)। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শেখ মুজিবকে প্রতিষ্ঠার হাস্যকর এই অপচেষ্টার আগে কয়েকটি প্রশ্নের জবাব ষ্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
"প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা চুড়ান্ত হয়েছে , ক্ষমতা হস্তান্তরের মতানৈক্য হয়েছে এবং আমি (বংগবন্ধু) আশা করি প্রেসিডেন্ট তা ঘোষনা করবেন"।
এবিষয়ে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বলেন:
"আমার দুঃখ হয় , এই নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কে আমার কোন মন্তব্য নেই"
[ সূত্র: রেপ অব বাংলাদেশ , অ্যান্থনি মাসকারেনহাস , অনুবাদ মযহারুল ইসলাম , ১৯৭৩ , পৃষ্ঠা:১১৩ ]
১. শেখ মুজিব ৭ ই মার্চ স্বাধীনতার ঘোষনা দিলে স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালন করা হচ্ছে কেন?
২. ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা হলে পরদিন ৮ই মার্চ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানতো বটেই এমনকি পূর্ববঙ্গের কোন পত্রপত্রিকায়ও সেই সংবাদ প্রকাশিত হয়নি কেন?
৩. ৭ মার্চের ভাষন যদি স্বাধীনতার ঘোষণা হয় তাহলে কিসের আশায় শেখ মুজিব পাকিস্তানীদের সঙ্গে তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে রূপসী বাংলা) ২৫ মার্চ পর্যন্ত দফায় দফায় বৈঠক করছিলেন?
৪. ৭ মার্চে ঢাকায় সেনা সংখ্যা ছিলো মাত্র বারো হাজার কিন্তু ২৫ মার্চ এই আপসরফার আলোচনায় সময়কালে ঢাকায় পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় লক্ষাধিক। আলোচনার নামে সময়ক্ষেপন করে এই সুযোগে কেন শেখ মুজিব পাকিস্তÍানী জেনারেলদেরকে ঢাকায় লাখো সৈন্য সমাবেশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন?
৫. পাকিস্তানীরা হামলা করলে কে কোথায় প্রতিরোধ গড়ে তুলবে সেই পরিকল্পনা কেন ছিলোনা? পাকিস্তানীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রতিদিন অপেক্ষমান দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের শেখ মুজিব কেন বলছিলেন “আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে।
৬. ৭ মার্চের ভাষন স্বাধীনতার ঘোষণা হলে এরপর যুক্তিসঙ্গতকারনেই শেখ মুজিবের যুদ্ধ প্রস্তুতি নেয়ার কথা ছিলো, প্রয়োজন ছিলো রণকৌশল ঠিক করার, শেখ মুজিব কি সেটি করেছিলেন।
৭. শেখ মুজিব ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে দীর্ঘ ৪৮ দিন পর অর্থাৎ ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলো কেন?
৮. ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানীদের সঙ্গে শেখ মুজিবের আলোচনা চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ হওয়ার পরও তিনি আত্মগোপনে না গিয়ে কেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ীতে বসে থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করলেন?
৯. বাঙালীকে ঘোর বিপদে রেখে তিনি কেন পাকিস্তান এবং পাকিস্তানীদের নিরাপদ মনে করলেন? স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে নিজের ঘরে বসে থেকে আত্মসমর্পন করার আর একটি নজীরও কি পৃথিবীর কোন দেশের ইতিহাসে আছে?
১০. স্বেচ্ছাসমর্পনের আগে শেখ মুজিব নিজের পরিবারের সদস্যদের কেন নিরাপদে পাক সেনাদের হেফাজতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন? কোন ভরসায়? কাদের ভরসায়?
১১. শেখ মুজিব তার দলের প্রথম সারির নেতাদেরকে কেন যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বলেন নি? কেন তাদেরকে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন?
১২. পাকিস্তানীরা ঢাকায় ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করছে জেনেও প্রশিক্ষিত বাঙালি সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেননি কেন? শেখ মুজিবের অদূরদর্শিতার কারণেই কি পাকিস্তানীরা যুদ্ধ শুরুর প্রথমরাতের প্রথমেই রাজারবাগে পুলিশ সদস্যদের উপর হামলা করেনি?
১৩. ৭১ সালের ২৫ শে মার্চের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে রাত সাড়ে ৮টায় শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের বাড়িতে সাংবাদিকরা গেলে কেন তাদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি?
১৪. এই ধরণের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্বের যে কোন নেতাই সাধারনতঃ সাংবাদিকদের কাছাকাছি রাখেন। কিন্তু শেখ মুজিব কেন তার উল্টোটা করলেন?
১৫. সেই সময় পূর্ব বাংলার উত্তাল পরিস্থিতিতে অনেক বিদেশী সাংবাদিকরাও ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। এমনকি তৎকালীন হোটেল কন্টিনেন্টালেও বিদেশী সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। শেখ মুজিব চাইলে ওই সময় দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের মাধ্যমেও স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার সুযোগ গ্রহন করতে পারতেন। কিন্তু সেই সুযোগ গ্রহন করলেন না কেন? ঢাকায় কোন সাংবাদিককে ফোন করেও স্বাধীনতার ঘোষনার কথা তিনি জানিয়েছেন এমন কোন প্রমাণও নেই।
১৬. মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে পাকিস্তানীরা গুলী করে পাখির মতো বাঙালিদের হত্যা করলেও তারা কেন শেখ মুজিবের পরিবারকে ঢাকায় রেখেছিলো আরাম আয়েশে?
১৭. শেখ মুজিবের পরিবারকে পাক সরকার প্রতিমাসে কেন ১৮শ রুপি করে পৌছে দিতো?
১৮. এ মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন পকিস্তানী বাহিনী নৃশংসতা চালিয়ে বাঙালিদের হত্যা করছিলো সেই সময় শেখ হাসিনা সন্তান সম্ভবা হলে পাকিস্তানীরা নিজেদের গাড়ীতে করে শেখ হাসিনাকে কেন হাসপাতালে নিরাপদে পৌছে দিয়েছিলেন? শেখ মুজিব এবং তার পরিবারের জন্য পাকিস্তানীদের এই দরদের নেপথ্য কারণ কি?
১৯. শেখ মুজিব স্বাধীনতা চাইলে মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে হাজার হাজার মাইল উড়ে এসে পশ্চিম পাকিস্তানীরা এতসংখ্যক বাঙালিকে হত্যা করতে পারতো?
২০. মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ৩০ লাখ বাঙালি হত্যা এবং ২ লাখ মা বোনের ইজ্জতহানির দায় কার? স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের সাথে মুজিবের বিশ্বাসঘাতকতাই কি এত প্রানহানির জন্য দায়ী নয়?
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইটে ২০১১ সালে এ বিষয়ে উল্লেখ করে, “Yahya Khan left Daca abruptly on 25 March 1971 and Tikka Khan let loose his reign of terror the same night. The next day, while the whereabouts of Mujib remained unknown, Major Ziaur Rahman announced the formation of the Provisional Government of Bangladesh over Radio Chittagong”.
অর্থাৎ মুজিবের নিখোঁজ অবস্থায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার কাজটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক। অনেকে আজ প্রশ্ন তুলেছেন- মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষনার কতৃত্ব নিয়ে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতা সত্বেও গণমানুষের দাবী- ‘স্বাধীনতা’, যা একজন সৈনিকের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে- এটাই বাস্তবতা। সময়ের দাবী কোনো পার্লামেন্টের পাশ করা আইন বা ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করে না। পাকবাহিনীর অন্যায় ও অমানবিক আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য সাড়ে সাত কোটি জনতার কাঙ্খিত স্বাধীনতা যুদ্ধ করে আদায়ের লক্ষ্যে প্রয়োজন ছিলো একটি ডাকের। আর সে ডাকই আসে চট্টগ্রাম থেকে। পক্ষান্তরে, আওয়ামীলীগের প্রস্তুতি এবং স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে জানা যায় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসান তরফদারের বর্ণনায়, “ফেব্রুয়ারী বা সম্ভবতঃ তার আগে থেকেই যে সমর প্রস্তুতি শুরু, তার অবশিষ্ট আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য মার্চের মাঝামাঝি থেকে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার ধুম্রজাল বিস্তার করা হয়। এই আলোচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে যুগপৎ সন্দিহান ও আশাবাদী থাকায় আওয়ামীলীগ নেতৃত্বের পক্ষে আসন্ন সামরিক হামলার বিরুদ্ধে যথোপযোগী সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা গ্রহন করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবতঃ একই কারণে ২৫/২৬ মার্চের মধ্যরাতে টিক্কার সমর অভিযান শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব স্বাধীনতার স্বপক্ষে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উঠতে পারেননি। শেষ মুহুর্তে আওয়ামীলীগ নেতা ও কর্মীদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েও সহকর্মীদের সকল অনুরোধ উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিব রয়ে গেলেন নিজ বাসভবনে। সেখান থেকে গ্রেফতার হলেন হত্যাযজ্ঞের প্রহরে” (সূত্রঃ মুলধারা ৭১)। শেখ মুজিব কি করে ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হলে সে সম্পর্ক পরিস্কার একটা বর্ণনা পাওয়া যায় লন্ডন টেলিগ্রাফের ঢাকা প্রতিনিধি Simon Dring ৩০ মার্চ ১৯৭১ এর HOW DACCA PAID FOR A UNITED’ PAKISTAN শিরোনামে টেলিগ্রোমে ”Mujib’s arrest: As this was going on. other units had surrounded the Sheikh’s house. When contacted shortly before 1 a.m. he said that he was expected an attack any minute and had sent everyone except his servants and bodyguard away to safety. A neighbor said that at 1-10 a.m., one tank, an armored car, and trucks loaded with troops drove down the street firing over the house. “Sheikh you should come down”, an officer called out in English as they stopped outside. Mujibur stepped out onto his balcony and said. “Yes. I am ready, but there is no need to fire. All you need to have done is call me on the telephone and I would have come”. The officer then walked into the yard and told Mujibur: “You are arrested” (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: তৃতীয় খন্ড পৃষ্ঠা ৭৯০). এই রিপোর্টের কোথাও সাইমন একটি শব্দ বলেন নি যে, মুজিব স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন।
যুদ্ধে অংশ গ্রহন না করে ঘরে বসে থাকা অথবা কলকাতা ফেরত আওয়ামী বুদ্ধিজীবী কিংবা আদালত নয় বরং এইসব প্রশ্নগুলোর জবাবের উপর ভিত্তি কোরেই দেশের জনগন রায় দেবে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষন স্বাধীনতার ঘোষনা ছিলো নাকি এটি ছিলো পাকিস্তানীদের উপর চাপ সৃষ্টি করে পাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খায়েস।
ওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী
সাম্যবাদের আদর্শ, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের কন্ঠ, মজলুম জননেতা
পাকিস্তানের মুলতানে কবি ও সাংবাদিক এরশাদ মজুমদারকে এক পাকিস্তানি সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের মধ্যে পার্থক্য কোথায়| প্রশ্নের জবাবে এরশাদ মজুমদার বলেছিলেন, মাওলানা সাহেবের সংসদ বা পার্লামেন্ট হচ্ছে ধানক্ষেত আর কল কারখানা। এই সংসদের সদস্যরা হচ্ছেন কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতা। আর শেখ সাহেবের লক্ষ্য হচ্ছে বুর্জোয়া ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতা হওয়া। যে গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে পাকিস্তানের ধনী পরিবাররা। সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল,তাহলে মাওলানা সাহেব কমিউনিস্ট পার্টি করেন না কেন? এরশাদ মজুমদারের উত্তর ছিল মাওলানা সাহেব ইসলামী সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। তিনি খোদা, খোদার কালাম আল কোরাণ ও বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত আল্লাহপাকের রাসুল হজরত মোহাম্মদকে সা: বিশ্বাস করেন।এ কারণেই তিনি মওদুদীর জামায়াতে ইসলাম সম্বন্ধে বলেছিলেন, নীল নদের পানি যেমন নীল নয়, জামায়াতের ইসলামও ইসলাম নয় । আসলেই এটা কোন ইসলাম নয় বরং এটা হল মওদূদীবাদ । কিন্তু সমস্যা হল আমাদের দেশের মানুষ ধর্মপ্রান তারা ইসলামকে ভালবাসে তাই ইসলাম শুনলেই যাচাই বাছাইয়ের মানসিকতা থাকে না|
১৯৬৪ সালে চীন থেকে ফিরে এসে মাওলানা সাহেব ইসলামী সমাজতন্ত্রের ডাক দিয়েছিলেন। এ নিয়ে তাঁর দল ন্যাপের কমিউনিস্ট সদস্যরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। ওই সময়েই বাম রাজনীতির ধারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। রাশিয়া মাওলানা সাহেবের চীন সফরকে ভাল চোখে দেখেনি। ফলে বাম রাজনৈতিক দল গুলো চীনপন্থী ও রুশপন্থী হিসাবে পরিচিত হতে থাকে। ৬২ সালে মাওলানা সাহেব চীন গিয়েছিলেন সরকারের অনুরোধে। জেনারেল আইউব মাওলানা সাহেবের কাছে ওয়াদা করেছিলেন চীনের সাথে বিশেষ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলে সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে। ওই সময়েই পূর্ব পাকিস্তানের সকল বামপন্থি নেতা মুক্তি লাভ করেন। যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে বা পলাতক ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে জারি করা হুলিয়া তুলে নেয়া হলো। মাওলানা সাহেবের উদ্যোগেই চীনের সাথে পাকিস্তানের সু সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। যা বাংলাদেশ হওয়ার পরেও অব্যাহত থাকে। বংগবন্ধুর আমলে সম্পর্কটা একটু শীতল ছিল ভারত ও রাশিয়ার চাপের কারণে।
৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের উপর ভারতের প্রভাবকে মোকাবিলা করার জন্যে বংগবন্ধু মাওলানা সাহেবের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। মাওলানা সাহেব ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহবান জানালেন। তাঁর সাপ্তাহিক পত্রিকা "হক কথা"র মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করেন। মাওলানা সাহেব ছিলেন শেখ সাহেবের পিতৃতূল্য ব্যক্তিত্ব। কোলকাতায় শেখ সাহেব সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাগরেদ থাকলেও পাকিস্তান সৃষ্টির পর মাওলানা সাহেবের নেতৃত্বেই রাজনীতি শুরু করেন। ৪৯ সালে মাওলানা সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে শেখ সাহেব নতুন দলের যুগ্ম সম্পাদক মনোনীত হন। ৫৪ সালের নির্বাচনের জন্যে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে আওয়ামী মুসলীম লীগ ছিল প্রধান দল। তার সাথে শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি সহ আরও বহু ইসলামিক ছোটখাট দল ছিল। শেখ সাহেব সাধারন মানুষের জন্যে রাজনীতি করতেন এটা ঠিক। কিন্তু টার্গেট ছিল ক্ষমতায় যাওয়া এবং তার মাধ্যমেই জনগণের খেদমত করা। মাওলানা সাহেব ছিলেন তার উল্টো। তাঁর কাছে লক্ষ্য ও আদর্শ ছিল শুধুই জনগণের খেদমত করা এবং জনগণকে অধিকার সচেতন করে তোলা। আসামে থাকতেও তিনি আসাম মুসলীম লীগের সভাপতি ছিলেন। স্যার সাদুল্লাহ ছিলেন তাঁরই দলের প্রধানমন্ত্রী।
মাওলানা সাহেব সাহাবি হজরত আবু জর গিফারী (রা)র একজন অনুসারী ছিলেন। কথা উঠলেই মাওলানা সাহেব হজরত গিফারীর ( রা ) নাম বলতেন। রাজধানীতে আবু জর গিফারী কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাওলানা সাহেবের পরামর্শ ও সমর্থনে। মাওলানা সাহেব ইসলামের বিপ্লবী চেতনার অনুসারী ছিলেন। নিজ জীবনে হজরত গিফারীর আদর্শ বাস্তবায়নের চেস্টা করেছেন সারা জীবন। তিনি বিশ্বাস করতেন সত্যিকারের ইসলাম বাস্তবায়িত হলে সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজমের কোন প্রয়োজন নেই।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জন্ম হয়েছিল এক সাধারণ পরিবারে ১৮৮০ সালে ১২ ফেব্র“য়ারি। সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে। জন্মের পর বাবা হাজী শরাফত আলী খান আদর করে ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘চেগা মিয়া’। বাবা-মায়ের স্নেহ বেশিদিন পাননি মওলানা ভাসানী। তাঁর বয়স যখন মাত্র ৬ বছর তখনই পিতার মৃত্যু হয়। তারপর এগারো বছর বয়সে মায়েরও মৃত্যু হয়।
শৈশবেই সকলকে হারিয়ে আব্দুল হামিদ এসে আশ্রয় নিলেন চাচা ইব্রাহিম খানের বাড়িতে। চাচা তাঁকে ভর্তি করিয়ে দিলেন সিরাজগঞ্জ শহরের এক মাদ্রাসায়। কিন্তু পড়াশোনায় মন বসল না আব্দুল হামিদের। একদিন চাচার সাথে অভিমান করে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গেলেন শাহজাদপুরে এক দূঃসম্পর্কের ভগ্নিপতির বাড়িতে। সেখানে গিয়ে পড়াশুনা ছেড়ে শুরু করলেন ক্ষেতমজুরের কাজ। ভাসানী যখন শাহজাদপুরে ক্ষেতমজুরের কাজ করেছিলেন তখন সেখানেই পরিচয় হয় পীর নাসিরউদ্দিন শাহ বোগদাদী’র সাথে। পীর সাহেবের এই অনাথ বালকটিকে পিতৃস্নেহে কাছে টেনে নিলেন। পরে পীরসাহেবের সাথেই তিনি চলে গেলেন ময়মনসিংহ জেলার বল্লাগ্রামে। সেখানে গিয়ে পীর সাহেবে ভাসানীকে আবার মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন।
মক্তবের পড়া শেষ করে শুরু করলেন শিক্ষকতা। মাদ্রাসার শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে চলে এলেন টাঙ্গাইলের কাগমারিতে। এখানে বছরখানেক থাকার পর তিনি পীরসাহেবের সাথেই চলে গেলেন আসামে। পীরসাহেবের আস্তানায়। তখন সারা ভারতে চলছিল ব্রিটিশবিরোধী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। ভাসানীও জড়িত হলেন দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে। তখন ভারতের বর্তমান উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। ভাসানী পীর সাহেবের অনুমতি নিয়ে চলে গেলেন দেওবন্দে। ভর্তি হলেন দেওবন্দ ইসলামিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি চলল তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ড। বলতে গেলে দেওবন্দ থেকেই ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু।
দেওবন্দের শিক্ষা শেষ করে ভাসানী আবার ফিরে এলেন আসামে। মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষা দানের জন্য পীরসাহেব তখন আসামের জঙ্গলে স্থাপন করেন ইসলাম প্রচার মিশন। ভাসানীও তখন মিশনের কাজে আত্মনিয়োগ দেন। মিশনের কাজ নিয়ে তিনি চলে এলেন বগুড়া পাঁচবিবিতে। এখানে পরিচয় হল জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর সাথে। ভাসানী জমিদার সাহেবের ছেলে মেয়েদের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হলেন। পরে শুধু গৃহশিক্ষকতা নয়, জমিদারী দেখাশোনা করারও দায়িত্ব পেলেন ভাসানী। জমিদারি সংক্রান্ত ব্যাপারে ভাসানীকে প্রায়ই কলকাতায় যাতায়াত করতে হত। কলকাতায় বিপ্লবী দলের কিছু কর্মীর সাথে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯১৯ সালে ময়মনসিংহে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন উপলক্ষেই ভাসানী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পান। ভাসানী তখন থেকেই দেশবন্ধুর অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ১৯১৯ সালেই ভাসানী অনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং অসহযোগী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলনে নেমে গ্রেফতার হন। তাঁর নয় মাসের জেল হয়। এটাই ভাসানীর প্রথম কারাবরণ। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯২১ সালে তিনি আলিভ্রাতৃদ্বয় অর্থাৎ মওলানা মোহাম্মদ আলি এবং শওকত আলির ডাকে খেলাফত আন্দোলন এবং একই সাথে দেশবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করলেন। আবারও গ্রেফতার হলেন তিনি। ১৯২২ সালে উত্তর বঙ্গ ও আসামে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। বিপন্ন মানুষের সেবায় এগিয়ে আসেন ভাসানী। কলকাতা থেকে এলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজি সুভাষ বসুসহ আরও অনেকে। ভাসানী এইসব জাতীয় নেতার সাথে দুঃস্থ মানুষের সেবায় দিনরাত কাজ করতে লাগলেন।
১৯২৫ সালে তিনি বগুড়ার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরীর কন্যা আলেমা খাতুনকে বিয়ে করেন। বিয়ের একবছর পর তিনি স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে যান আসামের ভাসানচরে। ১৯২৬ সালে তিনি আসামে শুরু করেন ‘কৃষক আন্দোলন’। তখন সব জমিদার মিলে ইংরেজ গভর্নরকে দিয়ে মওলানা ভাসানীকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করলেন। ভাসানীকে বাংলা থেকে বহিষ্কার আদেশ জারি করা হল। অবশেষে ভাসানী স্ব-পরিবারে গিয়ে ঠাঁই নিলেন আসামের গহীন জঙ্গলে-ঘাগমাড়া নামে এক জায়গায়। সাংগঠনিক কাজের জন্য মাঝে মাঝে কলকাতা বা অন্যান্য জায়গায় যেতে হলেও ভাসানী ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত লাগাতারভাবে আসামেই ছিলেন। তিনি ১৯২৯ সালে সিরাজগঞ্জের কাওয়াখোলা ময়দানে ‘বঙ্গ আসাম প্রজা সম্মেলন’ আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে প্রায় তিন লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল। সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
মওলানা ভাসানী লাইনপ্রথা ও বাঙাল খেদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন ১৯২৫ সালে। ১৯৩৭ সালে ভাসানী আসামের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে আসামের বারোটি জেলায় মুসলিম লীগের সংগঠন আরও জোরদার হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনেই আসামের ৩৪ আসনের মধ্যে ৩১ টি আসন লাভ করে। ভাসানী নিজেও আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। মুসলিম লীগের মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হওয়ার পরও ভাসানী তাঁর লাইনপ্রথা ও বাঙাল খেদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগলেন। ফলে সরকারের সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কেন্দ্রীয় লীগ নেতৃবৃন্দ তাঁকে নিজদলীয় সরকারের বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু ভাসানী তার আর্দশের প্রতি অটল রইলেন। ১৯৩৮ সালে তিনি রংপুরে গাইবান্ধায় কৃষক প্রজা সম্মেলনের আয়োজন করলেন।
১৯৪০ সালে তিনি জননেতা এ কে ফজলুল হকের সাথে মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। আসামের লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলন থেকে সরে থাকার জন্য স্বয়ং মুহম্মদ আলি জিন্নাহ পর্যন্ত তাঁকে অনুরোধ করেন। কিন্তু জিন্নাহর প্রস্তাবও ভাসানী প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে ভাসানীর আন্দোলনের মুখে ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আসামের মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটে। তবে পুলিশ বাঙালীদের ওপর গুলি চালায় এবং একজন নিহত হয়। ভাসানী গ্রেফতার হন।
১৯৪৭ সালের ২৯ জুন ভাসানী গৌহাটি কারাগার থেকে ছাড়া পেলেন। ছাড়া পেয়েই তিনি ছুটে এলেন সিলেটে। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব মুহুর্তে সিলেট পাকিস্তানের অংশ হবে কি না এই নিয়ে গণভোট হয়। ভাসানী সিলেটকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্তকরণের পক্ষে সমর্থন করেন। এই আন্দোলন সফল হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগষ্ট ভারত বর্ষ দ্বিখন্ডিতহয়ে জন্ম নিল দু’টি পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আসাম সরকার মওলানা ভাসানীকে অবিলম্বে আসাম ত্যাগের নির্দেশ দেয়। তিনি ফিরে এলেন টাঙ্গাইলের কাগমারিতে। ১৯৪৮ সালে প্রথম পূর্ববঙ্গ পরিষদের টাঙ্গাইল আসন শূন্য হলে ভাসানী উপনির্বাচনে অংশে নেন এবং খাজা নাজিম উদ্দিন মনোনিত প্রার্থী জমিদার খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করে পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু খাজা নাজিম উদ্দিন ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই উপনির্বাচন বাতিল ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয় ১৯৫০ সাল পর্যন্ত যাতে ভাসানী কোন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে এই মর্মেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ১৯৪৯ সালে সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় ফিরে এলে মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ভাসানী একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। ১৯৫৪ সালে বার্লিনে শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য ভাসানী লন্ডন সফরে গেলেন। কিন্তু তিনি পাকিস্তান সরকারের চক্রান্তের ফলে জার্মানি যাবার ভিসা পেলেন না। তিনি বিদেশে থাকা অবস্থায় শুনতে পারলেন পূর্ববঙ্গের যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাতিল করা হয়েছে এবং যুক্তফ্রন্ট নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তাই সেই মুহূর্তে তিনি দেশে ফিরতে পারেননি।
পরে ১৯৫৫ সালে সোহরাওয়ার্দি ভাসানীকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন। ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল কাগমারি সম্মেলন। ভাসানীর উগ্যোগে এই কাগমারি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। ভাসানীর সেই কাগমারি সম্মেলনের ফল বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন শেখ মজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে কাগমারি সম্মেলনের ১৪ বছর পরে পাকিস্তান সরকার ভেঙে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্মলাভের মাধ্যমে। সেই বছরই ১৯৫৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে সর্ম্পক ছিন্ন করে নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আ্ওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। ১৯৬৭ সালে ন্যাপ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ভাসানী হলেন চিনপন্থি ন্যাপের সভাপতি অপর দিকে মস্কোপন্থি ন্যাপের সভাপতি হলেন অধ্যাপক মুজাফর আহমদ। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হলে সারা দেশে গড়ে ওঠে আন্দোলন। ভাসানীও এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরীক হন। আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে ২২ ফেব্র“য়ারি সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু বের হয়ে আসার পর আইয়ুবিরোধী তথা পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন আরও জোর দার হয়। এই আন্দোলনের অন্যতম অগ্রনায়ক ছিলেন মওলানা ভাসানী।
১৯৭০ সালে ৭ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে মাওলানা ভাসানী অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া খান যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে লাগলেন তখন মাওলানা ভাসানী বজ্র কন্ঠে বললেন ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, বলি অনেক হইয়াছে কিন্তু আর নয়’। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ২২ ফেব্র“য়ারী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। মাওলানা ভাসানীর জীবনের আরেকটি বড় কাজ হল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। তিনি যুদ্ধের আগেই ১৯৭০ সালে ৮ ডিসেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় তা বাস্তবে রূপ লাভ করে। ভারত সরকারের গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ তৈরির প্রতিবাদে ১৯৭৬ সালে তিনি মিছিল বা লং মার্চ করেন। এটা ছিল তাঁর সংগ্রামী জীবনের আরেকটি বড় উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯৭৬ সালে ৫ এপ্রিল তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে ২৮ মে তাকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই হাসপাতালে ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর পরলোক গমন করেন। তাঁকে টাঙ্গাইলের সন্তোষের ইসলামীয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সমাধিস্থ করা হয়।
আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, গবেষক কেউই সঠিকভাবে মাওলানা সাহেবকে মুল্যায়ন করতে পারেননি। দেশের ইসলামপন্থীরা তাঁকে কমিউনিস্ট মনে করতেন। তাই তাকে তারা ইসলামের বাইরে মনে করতেন। বিদেশীরা বলতেন,‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ বা ‘মাও অব ইস্ট ইনডিজগাইজ অব এ প্রিস্ট’। তিনি বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে বিশ্ববাসীকে বলে এসেছেন, আমার ধর্ম শান্তির ধর্ম, আমার রাজনীতি শান্তির, আমি শান্তির মাঝেই বাস করি এবং শান্তিই আমার অভিবাদন। তিনি মাও সে তুংকে বলেছিলেন,আপনাদের সমাজতন্ত্রে খোদাকে জায়গা করে দিন আমি আপনাদের সাথে আছি।
আজ মাওলানা ভাসানীর ৩৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী| বাংলাদেশের মহান এই নেতার মৃত্যুবার্ষিকীতে পরম করুনাময় অসীম দয়ালু আল্লাহু তা’য়ালার দরবারে আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি| দেশের এই রাজনৈতিক সঙ্কটকালে তার আদর্শই হয়ে উঠুক আমাদের রাজনীতির পাথেয় |
শেখ মুজিব গ্রেফতার এবং কথিত টেলিগ্রাম
উত্তাল মার্চ : ১৯৭১ সাল
১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ ঢাকায় নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা। এই পরিষদই পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করবে। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান একাই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করতে পারেন। জনগণের কাছে তিনি ওয়াদাবদ্ধ, ৬ দফা ভিত্তিক হবে সংবিধান। পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ভুট্টো ৬ দফা মানতে রাজি নন। রাজি নয় পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী ও সেনাবাহিনী। তাই সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখলেন। এতে বিদ্রোহ করে উঠলো গোটা বাংলাদেশ। এমন বিদ্রোহ এই দেশে আমরা আগে কখনো দেখিনি। প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়লো। শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশেই সব কিছু চলতে লাগলো। তিনি নিজ বাসভবন থেকে যেভাবে নির্দেশ দিচ্ছেন, সেনাবাহিনী বাদে রাষ্ট্রের সকল প্রশাসন,ব্যাংক, অফিস-আদালত এবং জনগণ তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি যে ভাষণ দিলেন তা ছিল ঐতিহাসিক এবং অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত। এই ভাষণের রেকর্ড এখন প্রায়ই শোনা যায়। এই বক্তৃতায় তিনি একদিকে সরকারকে কয়েকটি শর্ত দিলেন, অপরদিকে, শেষ বাক্যে তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রামের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রামের মুক্তির সংগ্রাম।’ একদিকে, স্বাধীনতার ডাক,অপরদিকে, শাসনতান্ত্রিক উপায়ে আলোচনার পথ খোলা রাখলেন। বস্তুত, আলোচনা চললো। এদিকে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন তরুণ র্যাডিকাল নেতা স্বাধীনতার স্লোগান প্রকাশ্যেই দিচ্ছেন। স্বাধীনতার পতাকা পর্যন্ত উড়লো, এমনকি শেখ মুজিবের বাসভবনেও।
১১ মার্চ মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলে এক বিশাল সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ মেনে চলার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান রেখেছিলেন। আরো আগে, তিনি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়াজ তুলেছিলেন।
সেই সময় একটি কমিউনিস্ট সংগঠন ‘‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’’ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আমি নিজে এই সংগঠনের নেতৃত্বের একজন ছিলাম। টঙ্গি শিল্প এলাকায় আমাদের ভালো সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল। টঙ্গির শ্রমিকদের ব্যাপক সমর্থনের কারণে, আমরা টঙ্গির কারখানাগুলোকে ব্যবহার করে বোমা বানাতাম। গ্রামাঞ্চলে আমাদের কৃষকের ঘাটি অঞ্চল সমূহে সেই সকল বোমা সরবরাহ করা হতো। শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর এটাও এক চমৎকার দৃষ্টান্ত ছিল। ফেব্র“য়ারি মাসেই আমরা পার্টি কর্মীদের সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রসস্তুত হতে বলি এবং গেরিলা যুদ্ধের কৌশলল সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। আমাদের তৈরি হাতবোমা ঢাকায় মিলিটারি গাড়ির ওপরও নিক্ষেপ করা হয়। বিকট আওয়াজ হতো। কিন্তু কার্যকারিতা তেমন ছিল না। আমরা বিভিন্নভাবে কিছু বন্দুকও সংগ্রহ করি। তবে প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হলেই কেবল বোঝা গেল আমাদের সামরিক প্রস্তুতি কতো অপ্রতুল ছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বিকেলে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির’ নামেই পল্টনে এক সভা আহ্বান করা হয়েছিল এবং এতে দুই লক্ষাধিক মানুষ জমায়েত হয়েছিল। আমাদের সাংগঠনিক শক্তি কিন্তু এতোটা ছিল না। পরিস্থিতির কারণেই সেদিন মানুষ জমায়েত হয়েছিল। ওই সভায় কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আনোয়ার খান জুনো, আতিকুর রহমান সালু ও আমি বক্তৃতা করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম,মুজিব-ইয়াহিয়া যে আলোচনা চলছে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। আমরা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান রেখেছিলাম। সেই রাতেই পাকিস্তান আর্মি অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র জনগণের ওপর। শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হলেন।
মার্চ মাসে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সেনাকর্মকর্তা শেখ মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। সামরিকভাবে কি করা উচিত, সেই নির্দেশ চেয়েছিলেন নেতার কাছ থেকে। কিন্তু নির্দেশ তারা পাননি। বস্তুত জাতিও কোন নির্দেশ পায়নি। মার্চ মাসে তিনি একবার বলেছিলেন যে, ‘সেই শ্রেষ্ঠ সিপাহসালার যে বিনা রক্তপাতে যুদ্ধ জয় করতে পারে।’ এই একই কারণে ২৫ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা ও নেতৃস্থানীয় কর্মীদের পালিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেও নিজে গ্রেফতার হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকলেন। কারণ, তার নিজের ভাষ্যমতে, তিনি পালিয়ে গেলে ব্যাপক রক্তপাত হবে। আমরা জানি যে, তিনি ধরা পড়া সত্ত্বেও কম রক্তপাত হয়নি। বস্তুত, শেখ মুজিব ইতিহাসের এক বিশাল মাপের নেতা হওয়া সত্ত্বেও আত্মগোপনে গিয়ে বিপ্লবী রাজনীতি করা তার অভ্যাসে ছিল না। সামরিক বিষয়েও তার কোন ধারণা ছিল না। ’৭১-এর সশস্ত্র যুদ্ধে তিনি যদি সরাসরি উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব প্রদান করতেন, যেমন করেছিলেন আমাদের দেশেরই ইতিহাসের আরেক মহান নেতা সুভাস চন্দ্র বসু, তাহলে হয়তো স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসের গতিধারা ভিন্নরূপ হতে পারতো।
সেই মুজিবুর রহমান প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জানতে পারেননি, কিভাবে নয় মাস যুদ্ধ হয়েছে, কতো মানুষের প্রাণ গেল, কারা যুদ্ধ করেছে, কী বিভৎস ছিল পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা অথবা সুনির্দিষ্ট কতকগুলো প্রশ্নে ভারত সরকারের কি ভূমিকা ছিল ইত্যাদি।
২৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত আলোচনা চলেছিল। তিনি কি বন্দী হওয়ার আগে স্বাধীনতার কোন ঘোষণা দিয়েছিলেন?পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ঢাকায় ফিরে এসে তিনি জানালেন যে, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তিনি চট্টগ্রামে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্র“মুক্ত হওয়ার পর প্রায় এক মাস পর্যন্ত জহুর আহমেদ চৌধুরী (যার কাছে তিনি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন বলে জানিয়েছিলেন)সহ চট্টগ্রামের কোন নেতাই এই সংবাদ জানাননি। অর্থাৎ তারা কোনো টেলিগ্রাম পাননি। পাবার কথাও নয়। কারণ, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে,সেই সময়ে যদি ঢাকা থেকে টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েও থাকে, তা চট্টগ্রামে পৌঁছাতে পারে না। কারণ, ওই সময়ের আগেই যুদ্ধ জাহাজ থেকে ছোড়া বোমার আঘাতে চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
এক রকম অপ্রস্তুত অবস্থায় কোন দিকনির্দেশনা ছাড়াই জনগণ সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লো। প্রথমে যুদ্ধ শুরু করলেন বাঙালি সেনারা। তবে এর আগেই ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে পূর্বদিকে সরে যাচ্ছিলেন। (১ ও ২ এপ্রিল রাশেদ খান মেনন ও আমি কিশোরগঞ্জে এই বিদ্রোহী সৈন্যদের দেখেছিলাম।) তবু তখনো স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়নি। কারণ, তখনো ঢাকা দুই পক্ষের মধ্যে সংবিধান নিয়ে আলোচনা চলছে।
২৬ মার্চ মেজর জিয়া চট্টগ্রামের রেডিও থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ করে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনালেন। ঐতিহাসিক তাৎপর্য দিন এবং তিনি ডাক দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নিয়েই।
মোটকথা এইভাবে অপ্রস্তুত অবস্থায় বাঙালি স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমেছিল। তবে, ইতোমধ্যে যে মানসিক প্রস্তুতি তৈরি হয়েছিল এবং স্বাধীনতার জন্য উদগ্র আকাঙ্খা ছিল, সেটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
৬. মুক্তিযুদ্ধ : বহুমুখী সশস্ত্র তৎপরতা
মুক্তিযুদ্ধ একক কমান্ডে হয়নি। প্রবাসী সরকারের অধীনস্থ যে অফিসিয়াল মুক্তিফৌজ ছিল, তার কমান্ড স্টাকচার বা সেনাপতিমন্ডলী গঠিত হয়েছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত (অথবা সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত)সেনা অফিসারদের দ্বারা, যারা ভারতে অবস্থান করতেন। তারাই ছিলেন সেক্টর কমান্ডার, সাব সেক্টর কমান্ডার ইত্যাদি। এদের অধীনে পাকবাহিনীর বাঙালি সিপাহী, পুলিশ ইত্যাদি ছাড়াও ছিলেন স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণ,যাদেরকে বলা হতো এফএফ (অর্থাৎ ফ্রিডম ফাইটার)। এই অফিসিয়াল আর্মিতে যাতে এফএফ হিসেবে কোনো বামপন্থী ঢুকে না পরতে পারে, সেই ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও ভারত সরকার খুব সতর্ক ছিলো।
অফিসিয়াল আর্মি প্রধানতঃ সীমান্তের ওপার থেকে আক্রমণ চালিয়ে দ্রুত নিরাপদে ভারত ভূমিতে ফিরে যেতো। দেশের মধ্যে থেকেও বরিশাল সুন্দরবন অঞ্চলে কেউ কেউ যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা কম।
এছাড়াও ভারত সরকার স্বীকৃত আরেকটি স্বতন্ত্র মুক্তিফৌজ ছিল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে, যা কাদেরিয়া বাহিনী নামে পরিচিত। টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলে তাদের তৎপরতা ছিল। কাদেরিয়া বাহিনীর উপর প্রবাসী সরকারের বা সরকারি বাহিনীর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সোভিয়েত সরকারের চাপে ইন্দিরা সরকার বাধ্য হয়েছিল,তথাকথিত মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের তরুণদের আলাদা করে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে ও অস্ত্র সরবরাহ করতে। তারা প্রবাসী সরকারের অধীনস্থ অফিসিয়াল মুক্তিফৌজের কমান্ডের বাইরে ছিল। এমনকি উভয়ের মধ্যে কোন সমন্বয়ও ছিল না। অবশ্য সকলেই ভারতের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। সিপিবি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের বাহিনীর একটি দল মনজুরুল আহসান খানের নেতৃত্বাধীনে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে সীমান্ত অতিক্রমকালে, বাংলাদেশে প্রবেশের মুখে, কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার বেতিয়ারা নামক স্থানে পাক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং তাদের নয়জন শহীদ হন।
ভারত সরকারের বিশেষ তত্ত্বাবধানে ছিল আরও একটি বিশেষ বাহিনী, যারা বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের কমান্ডের বাইরে ছিল। আওয়ামী লীগের বাছাই করা কর্মীদের দ্বারা, এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ প্রমুখ এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। এই বাহিনীর নাম ছিল বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স। বাহিনীর একটা ডাক নাম ছিল মুজিব বাহিনী। এই বাহিনী সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা আবশ্যক।
বাম কমিউনিস্টদের মধ্যেও তখন অনেক বিভক্তি ছিল। ফলে, একেক অংশ একেকভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। পরস্পরের মধ্যে কোন যোগাযোগ পর্যন্ত ছিল না। আবার বামপন্থীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ ‘দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি’র চরম বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব উপস্থিত করে, কার্যত এই মহান যুদ্ধের বিরোধিতাই করেছিল। এই ক্ষুদ্র অংশের এই ভূমিকার কারণে বুর্জোয়ারা বাম কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের সুযোগ পেয়েছিল।
বাম শিবিরের মধ্যে সর্বাধিক যুদ্ধ করার রেকর্ড ছিল ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’র - যার নেতৃত্বে ছিলেন কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, আবদুল মান্নান ভূইয়া, হায়দার আকবর খান রনো,হায়দার আনোয়ার খান জুনো, মোস্তফা জামাল হায়দার প্রমুখ। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির নিয়ন্ত্রণাধীন সারাদেশে ছোট বড় ১৪টি গেরিলা বাহিনী গড়ে উঠেছিল এবং সারাদেশে সহযোগী যোদ্ধা মিলিয়ে বিশ হাজার গেরিলার এক বিশাল বাহিনী, যার মধ্যে শতাধিক শহীদ হয়েছিলেন। এই সংগঠনটির গেরিলা তৎপরতার সামান্য কিছু বিবরণ এখানে তুলে ধরা হবে। তবে পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরা সম্ভব নয়, প্রথমত. রচনার সীমাবদ্ধ পরিসরের কারণে এবং দ্বিতীয়ত. সামগ্রিক তথ্যের অভাবে। চার দশকের সময়ের ব্যবধানে অনেক ঘটনা স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে এবং যাদের কাছ থেকে জানা যেত, তাদেরও অনেকে আজ পৃথিবীতেই নেই।
বাংলাদেশ :: ধর্ষণ-যৌন নির্যাতনের এক উপদ্রুত জনপদ
প্রয়াত কবি-লেখক-প্রাবন্ধিক হুমায়ুন আজাদের “১০,০০০ এবং আরো একটি ধর্ষণ” উপন্যাসটির মুখবন্ধ ছিল এরকম - “বাঙলাদেশ এখন হয়ে উঠেছে এক উপদ্রুত ভূখন্ড; হয়ে উঠেছে ধর্ষণের এক বিশাল রঙ্গমঞ্চ,৫৬,০০০ বর্গমাইলব্যাপী পীড়নের এক বিশাল প্রেক্ষাগার। ধর্ষিত হচ্ছে মাটি মেঘ নদী রৌদ্র জোৎস্না দেশ, নারীরা”। এ উপন্যাস প্রকাশের পর পেরিয়ে গেছে এক যুগ। পদ্মা-যমুনায় জল গড়িয়েছে অনেক। সব্যসাচী লেখক হুমায়ুন আজাদও নিহত হয়েছেন ধর্ম ব্যবসায়ীদের হিংস্র নখরে।
এর মধ্যে রাজা বদল হয়েছে বার তিনেক। কখনো সামরিক লেবাসে, কখনো গণতন্ত্রের লেবাসে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট আদৌ বদলায়নি। উপদ্রুত ভূখন্ড হিসেবে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে প্রতিদিন ধর্ষণের এক বিশাল রঙ্গমঞ্চ। পাঠকের মনে পড়বে, ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রলীগ ক্যাডার মানিক ধর্ষণের সেঞ্চুরী পূরণ করে উৎসব উদযাপন করেছিল। এই সোনর মানিক বিচারের মুখোমুখি হয়নি, যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে নারী ধর্ষণে, বিশেষ করে সংখ্যালঘূ নারীদের ওপরে। এরও কোন বিচার আজ অবধি বাংলাদেশের মাটিতে হয়েছে, এমন দাবি কোন সরকার বা কোন রাজনৈতিক দল করতে পারবে না। এই দফায় ক্ষমতায় এসেও আওয়ামী লীগ ধর্ষণসহ যৌন নির্যাতনকে এক ধরনের দায়মুক্তি প্রদান করেছে। যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন শিক্ষক, মা-বাবা, ভাই-বোনসহ অনেকে। শত শত ঘটনা ঘটেছে কিন্তু বিচার হয়েছে কতোজনার? আর বিভিন্ন সময়ে বিচারহীনতার কারণেই বাংলাদেশ হয়ে পড়েছে ধর্ষণসহ যৌন নির্যাতনের এক উপদ্রুত জনপদ।
নারী ধর্ষণের ভয়াবহ চিত্রটি বাংলাদেশে এখনও অপরিবর্তিত। আমরা যদি ২০১৩-২০১৪ সালের পরিসংখ্যানটি দেখি, পাঠক দেখবেন এ সময়কালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০২১ জন নারী। এর মধ্যে চলতি বছরের মাত্র ৬ মাসে ৩০৯ জন এবং গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৮ জন। ২১ জন নারীকে ধর্ষনের পর খুন করা হয়েছে, ৭ জন আত্মহত্যা করেছেন আর ৪৪ জন নারীর ক্ষেত্রে ধর্ষণ চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ওয়েবসাইট থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। তারা মূলত: সংবাদপত্র ও নিজ সংস্থার উদ্যোগে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন। কিন্ত এই পরিসংখ্যানটি যথেষ্ট নয়, কারন বাংলাদেশে ধর্ষণ এক নীরব অধ্যায়। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলি প্রকাশ্্েয আসে না, মামলা হয় না, সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় না, প্রতিদিন ঘটে এসব ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে ৯ মাসে প্রায় ২ লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। সেটি ছিল শত্রু কবলিত দেশে, একটি বর্বর বাহিনীর হাতে নারীরা এরকম মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে চিত্রটি কি খুব পাল্টেছে? উত্তর কোন সরকার বা কোন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা ছাড়া ধর্ষণের বিরুদ্ধে বা ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন প্রতিরোধ আজ অবধি গড়ে তুলতে পারেননি।
চার দশক যোগ চার বছর আগে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। সশস্ত্র একটি যুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয়ার প্রসব বেদনাটি থাকে কঠিন, প্রচন্ড যন্ত্রনা তার মধ্যে থাকে জায়মান। যে কোন সশস্ত্র যুদ্ধের প্রথম শিকার হয় মানবতা, দ্বিতীয় হচ্ছে শালীনতা; যা প্রকাশিত হয় শোধ আর বদলা নেয়ার আকাঙ্খায়। শোনিতাক্ত বর্বরতা এবং যুদ্ধের অনিবার্যতায় হত্যা, নির্যাতনসহ বীভৎস সব ঘটনা পরম্পরায় বাঙালী জাতিকে কাটাতে হয়েছে নয় মাস। যুদ্ধ প্রকৃতিগতভাবে হত্যাভিলাষী। প্রতিরোধের যুদ্ধ শুরু হয় ঠিক উল্টো পথে। এখানে স্বপ্নের বীজ বপন করতে হয় এবং স্বপ্নকে টেনে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহে মানুষ অবিরাম লড়াই চালিয়ে যায়। যা যুদ্ধোত্তীর্নকালে শানিত চেতনায় রূপ নেয়। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, যার মধ্যে তিন কোটি নারী। যুদ্ধের শিকার এসব নারীরা একসময় এ রাষ্ট্রের দায় হয়ে পড়েছিল এবং রাষ্ট্র তাদের চরম নির্মমতায় ছঁড়ে ফেলেছিল। কর্মদক্ষতা ও প্রচেষ্টায় এই নারীরাই এখন রাষ্ট্রের সম্পদ এবং দিগন্তে তাদের সম্মেলিত সাফল্যের জন্য তারা আলোচিতও বটে। তারপরেও ঘরে-বাইরে নারী কোথাও কি নিরাপদ? স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছর পরে পরিস্থিতি কি আদৌ পাল্টেছে? নারীর প্রতি সংঘটিত সহিংসতা এবং অপরাধের পরিসংখ্যান অন্তত: সে রকম কোন আশা জাগায় না।
গত এক দশকে সামাজিক সূচকসমূহে বাংলাদেশের বিষ্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর অনেক বড় অবদান থাকলেও পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারীর অবস্থা এবং অবস্থানের উলে#খযোগ্য কোন বদল হয়নি। দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশ পরিবারে এখনও নানাধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ শারীরিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক নির্যাতন এবং ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এক্ষেত্রে যে তথ্যটি সবচেয়ে বিষ্ময়কর তা হচ্ছে, ৭৭ শতাংশ নারী পরিবারে সবরকম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এদের মধ্যে একটি বড় অংশই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও স্বামীর যৌনাকাঙ্খা চরিতার্থ করার শিকারে পরিনত হচ্ছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)এই প্রথম সারাদেশে নারী নির্যাতন নিয়ে পরিচালিত জরীপে এইসব তথ্য তুলে নিয়ে এসেছে। ভায়োলেন্স এগেইনষ্ট উইমেন সার্ভে ২০১১ নামে এই জরীপের আগে বিভিন্ন সংস্থার এ বিষয়ে আলাদা আলাদা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তবে সরকারের এই জরীপ জানাচ্ছে, দেশে নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে, ধরন পাল্টাচ্ছে এবং নারীরা ক্ষেত্রবিশেষ চরম বর্বরতার শিকার হচ্ছেন। গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১২ এটি প্রকাশিত হয়। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী গ্রামীন নারীরা নির্যাতনের শিকার হন বেশি। এক্ষেত্রে অবিবাহিতরা যৌন নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যে বেশি থাকলেও বিবাহিত নারীরা বেশিরভাগ শিকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের।
জরীপে চার ধরনের নির্যাতনের কথা উঠে এসেছে, এগুলি হচ্ছে, শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে ৪৫ শতাংশ নারীকে স্বামীরা চড় বা ঘুষি মেরে আহত করেছেন, ১৫ শতাংশ লাথি বা নিষ্ঠুর মারধরের শিকার হয়েছেন, যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ নারী ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্বামীর সংগে শারীরিক মিলনে আহত হয়েছেন। আর ৩০ শতাংশ নারী স্বামীর ভয়ে অনিচ্ছা সত্বেও শারীরিক মিলনে বাধ্য হচ্ছেন। জানা গেছে, বিগত এক বছরে এক-চতুর্থাংশ নারী, যাদের বয়স ২০-৩৪ বছরের মধ্যে তারাই এক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। এই পরিসংখ্যানটি গত এক বছরের মধ্যে সংগঠিত নির্যাতনের। ধারনা করা হয়,ঘরের ভেতরে নারীরা নিরাপদ, তবে এ জরীপ জানাচ্ছে উল্টো তথ্য। ঘরের ভেতরে স্বামী ও আপনজনের কাছে নারী সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকেন এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। বিয়ের আগের চিত্রটিও নারীর জন্য ভয়াবহ। প্রায় ৪২ শতাংশ নারী জানাচ্ছেন, তারা ১৪ বছর বয়সের আগেই জোরপূর্বক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, আর ৩৫ শতাংশ নারীর এ অভিজ্ঞতা হয় ১৯ বছর বয়সে পা দেবার আগেই।
হুমায়ুন আজাদের “১০,০০০ এবং আরো একটি ধর্ষণ” উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটে এভাবে- ধর্ষনের শিকার ময়নাকে দাঁড়াতে হয় বিজ্ঞ জজের সামনে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি রেপিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করনি? ময়না বলে না, করিনি।
বিজ্ঞ জজ: তুমি তাগো চিনতে পারছিলা।
ময়না: হ, চিনতে পারছিলাম।
জজ: তাহলে মামলা কর নাই ক্যান।
ময়না: মামলা কইর্যা কি অইব? এই হুয়ুরের দ্যাশে হুয়ুরগো বিরুদ্ধে মামলা কইর্যা কি অইবো।
জজ: তুমি এইটা কি বলতেছ!
ময়না: বিজ্ঞ জজ সাব, আপনে কি জানেন, আমারে থানায় আইন্যা চাইর দিন ওসি আর দারোগা-পুলিশে ধর্ষণ করছে।
জজ: তুমি কও কি?
ময়না: আহেন, আপনেও আমারে ধর্ষণ করেন………।
উপন্যাসটির শেষের অংশটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এখনো সেরকমই আছে। ময়নারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন কোন না কোনভাবে প্রতিদিনই। তাদের পক্ষে কেউ দাঁড়াচ্ছেন না। প্রতিবাদ করছে না। সমাবেশ,মিছিল, সভা, করছে না। ধর্ষণ অভিযোগে মামলা হয় সবচেয়ে কম, মামলা হলে বিচার প্রক্রিয়া অপরাধীদের দণ্ড কার্যকরের দৃষ্টান্ত আরো কম, আবার মামলা প্রমান করার ক্ষেত্রে ধর্ষনের শিকার নারী আইনী ও সামাজিক সহায়তাগুলিও ঠিক-ঠাক মতো পান না। সবচেয়ে ট্রাজেডি হচ্ছে, প্রমানের অভাবে ধর্ষনের দায়ে অভিযুক্তরা অনেকক্ষেত্রেই খালাস পেয়ে যান। এর সাথে যুক্ত হয় অন্য ট্রাজেডি, আমাদের রাষ্ট্র-সমাজ-ব্যক্তি ধর্ষককে ঘৃনার চোখে দেখে না, বদলে ধর্ষণের শিকার নারীকে পরিবার-সমাজ সর্বত্রই হতে হয় বিগ্রহের শিকার। অনেক সময় শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া ঐ নারী করুণ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। বাংলাদেশে নাগরিক সমাজ যে ক’টি ধর্ষণের ঘটনায় স্বোচ্চার হতে পেরেছিলেন, সেক্ষেত্রে কোনটিই কি বিচারের আলোয় এসেছে, নাকি ধর্ষকরা সাজা পেয়েছে? মোট কথা, বিচারহীনতার একটি স্থায়ী কালচার গড়ে ওঠার কারনে অন্যান্য ভয়াবহ অপরাধের পাশাপাশি নারী ধর্ষণের মত মানবতাবিরোধী অপরাধ কমছে না, বেড়েই চলেছে।
এই বাংলাদেশে এখন জননিরাপত্তা বলতে প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। আর এই সাধারন জনগনের মধ্যে আরও দুর্বলতম অবস্থানের মানুষ নারীর নিরাপত্তাহীনতার কথা তো উল্লেখই করার দরকার নেই। দেড় বছরে যদি এক হাজারেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয় একটি দেশে তাহলে নিরাপত্তাহীনতার যে চিত্রটি ফুটে ওঠে সে সম্পর্কে দেশের দুই প্রধান নেত্রীর বক্তব্য জনগনের জানতে ইচ্ছে করে। ক্ষমতা আর শুধুই ক্ষমতার মোহে আকন্ঠ নিমজ্জিত এইসব রাজনীতিবিদদের কাছে মানুষের কোন মূল্য আছে বলে মনে হয় না। মুখে যতই তারা ন্যায় বিচারের কথা বলুন না কেন, বিচারহীনতার কালচারটিকে তারাই স্থায়ীত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নকারী অথবা স্বাধীনতার ঘোষক বা মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার- যাই দাবি করুন না কেন, একাত্তরে পাক হানাদারদের বর্বরতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ন্যায় বিচারের সংস্কৃতি বা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কোন পদক্ষেপই আমাদের রাজনীতিকরা কখনও কি ভেবেছেন? এই প্রশ্নের জবাব আজ হোক, কাল হোক-জনগনের কাছে তাদের দিতেই হবে ।।
<
p align="JUSTIFY">
No comments:
Post a Comment
Thank you very much.